এ দেশের বিদূষকেরাই এখন শ্রেষ্ঠ

বিদূষককে আপনাদের না চেনার কোনো কারণ নেই! আপনারা না চাইলেও এরা আপনাদের সামনে সদা হাজির থাকেন। বিদূষক শব্দের অর্থ বাংলা একাডেমি অভিধানে ‘কৌতুকী, ভাঁড়। সংস্কৃত নাটকে রাজার বা নায়কের রঙ্গরস সৃষ্টিকারী অনুচর।’ বিশেষণ হিসেবে বিদূষকের মানে ‘কুৎসাকারী, নিন্দক, নিন্দুক।’ অনলাইন অভিধানে আবার বিদূষকের বাস্তব চেহারাগুলো আরেকটু অভ্রান্তভাবে ধরা আছে, ‘বিদূষক ১. (বিশেষ্য পদ) নাট্যে নায়কের রসিক সহচর, ভাঁড়। ২. (বিশেষণ পদ) নিন্দক, নিন্দাকারী; কামুক, লম্পট।’

আপনারা এঁদের চেনেন। পর্দা খুললেই এঁদের দেখা যায়। হাতে তেলের ডিব্বা নিয়ে এরা রাজদরবারে হাজির হন। রাজাকে হাসান। রাজার মন ভালো করে দেন। নায়ক ওয়াসিমের পাশে এরা দিলদার। রাজ্জাকের সঙ্গে হাসমত। এঁরা অমর। এঁরা অজর। এই সুজলা-সুফলা বাংলায় এঁরা আছেন সেই সুদূর অতীতকাল থেকে। রবীন্দ্রনাথ এঁদের নিয়ে কাব্য রচনা করতে বাধ্য হয়েছেন।

‘শুনে বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, “মারিয়া করিব খুন।”
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।’

বাবুর চেয়ে পারিষদ-দলের বলার পরিমাণ শতগুণ, তাতে যেমন শব্দের তীব্রতা ও তীক্ষ্ণতা বেশি, তেমনি শব্দসংখ্যা অজস্র, অপরিমেয়। এই শব্দরাজিতে, বাবুর যদি ঝাঁজ থাকে, বিদূষকের থাকে ঝাল, বাবুর যদি তিল থাকে, বিদূষকের থাকে তাল।

তৈলবাজিতে, চামচাগিরিতে চামচায় চামচায় থাকে প্রতিযোগিতা। এক আশ্রিত, উচ্ছিষ্টভোগী আরেকজনকে সব সময় প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে, নিজের হালুয়া–রুটির বখরা নিয়ে থাকে সদা শঙ্কিত! হারাই হারাই সদা থাকে ভয়। তো রাজা যদি বলেন হুঁ, এক বিদূষক বলবে, হুক্কা, বাকিরা কোরাস ধরবে, হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া। ও আমার চেয়ে বেশি তেল দিয়ে ফেলল না তো! আনো পিপে, ঢালো তেল।

কাজী নজরুল ইসলামও এঁদের নিয়ে কবিতা লিখে গেছেন।
সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!”
মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে!
হুজুরের মতে অমত কার?”

এই বিদূষকদের নিয়ে বাংলার প্রবাদ-প্রবচনগুলো তাই পরিপূর্ণ। সূর্যের চেয়ে বালির তাপ বেশি। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। বিদূষকদের সবচেয়ে বড় গুণ এঁরা নির্লজ্জ, বেশরম। এঁদের দুই কান কাটা। এক কান কাটা লোক রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটে, কিন্তু দুই কান কাটা লোক হাঁটে রাস্তার মধ্যভাগ দিয়ে। এঁদের চক্ষুলজ্জার বালাই নেই।

এঁরা রাজা-রাজড়াদের তুষ্ট করেন। এটাই তাঁদের নেশা–পেশা এবং অহোরাত্রির সাধনা। কিন্তু অভিধানে এঁদের কেন নিন্দাকারী, আর কামুক ও লম্পট বলে চিহ্নিত করল, তা–ও একটু বিশেষভাবে ভাববার বিষয়ও বটে।

এঁরা রাজাকে হাসান। একবার রাজা জিজ্ঞেস করলেন, গোপাল ভাঁড়, বলো তো আমার রাজ্যের লোকেরা এই মুহূর্তে কী ভাবছে? গোপাল ভাঁড় বলল, এরা সবাই ভাবছে, মহারাজার মঙ্গল হোক! রাজা একে শুধান, ওকে শুধান, তুমি কি ভাবছ যে মহারাজার জয় হোক। সবাই একবাক্যে বলে উঠল, আজ্ঞে মহারাজ, আমরা তা-ই ভাবছি।

এঁরা হাসান। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এঁদের চেয়ে দুঃখী, করুণ মর্মান্তিক পরাজিত মানুষ আর কেউ নেই। কারণ, এসবই এঁরা করেন দুমুঠো ভাতের জন্য, দুটো মোহরের লোভে, একটু ইনামের আশায়। একটা প্লট, একটা টেন্ডার, একটু বিদেশ সফর, একটা সরকারি পদ, একটা লাইসেন্স, একটুখানি তদবির-বাণিজ্যের জন্য। গাছটা না থাকলে আমি পরগাছা যে থাকব না। গাছ, তুমি বেঁচে থাকো, সুস্থ থাকো, দীর্ঘজীবী হও। তুমি চুল, তুমি না থাকলে আমি উঁকুন যাব কই, তুমি অন্ত্র, তুমি না থাকলে আমি কৃমি যে গৃহহারা হব! হারাই হারাই সদা হয় ভয় হারাইয়া ফেলি চকিতে!

কাজেই এঁরা জয়ধ্বনি করে যান। কাজেই এঁরা তৈলমর্দনে সদা লিপ্ত, সদা ব্যস্ত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যথার্থই বলেছেন, ‘বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।’ রাজা আসে, রাজা যায়। কিন্তু বিদূষকেরা যান না। এঁরা লেহন করবার জন্য পা বদল করে ফেলেন।

রাজা সত্য নয়, কিন্তু বিদূষকেরা সর্বকালে সর্বযুগে সর্ব-আমলে বিরাজমান। এঁরা অ্যামিবার মতো। আকার বদলে ফেলতে পারেন। এঁরা স্বর্ণলতার মতো, আশ্রয়দাতা গাছ পেলেই আবার জেঁকে বসেন। রাজা চিরকাল থাকেন না, কিন্তু বিদূষকেরা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। এঁরা ভাবেন, এই যে রাজার মনতুষ্টি করছি, দুটো ইনাম পাচ্ছি, রাজ্যবাসী নিশ্চয়ই আমাদেরও সেই রকম ভাবে, শ্রদ্ধা করে, শ্রদ্ধা না করুক, ভয় পায়। উপকার করার ক্ষমতা না থাকুক, আমাদের তো ক্ষতি করবার ফণা আছে।

কিন্তু এঁরা জানেন না, মানুষ এঁদের দেখে হাসে। এই হাসি খুশির হাসি নয়। এই হাসি প্রবুদ্ধের হাসি নয়। এই হাসি উপহাসের হাসি। এই হাসি বিদ্রূপের হাসি। লোকেরা নিতান্তই ভদ্র বলে, কিংবা নির্বিবাদী বলে এঁদের মুখের ওপরে কিছু বলে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে এঁদের করুণা করে; আফসোস করে বলে ওঠে, এই বাঁচার কী মানে! এইভাবে লোক হাসিয়ে বাঁচা!

বিদূষকেরা এই করুণারই কেবল যোগ্য!
বিদূষকেরা চিরদিন ছিলেন, তবে এখন বিদূষণ পেশাটাকে এঁরা উৎকর্ষের চরম শিখরে নিয়ে যেতে পেরেছেন। এ দেশের বিদূষকেরা সর্বদেশের শ্রেষ্ঠ বলে নিজেদের দাবি করতে পারেন।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক