সিরিয়ায় কনস্যুলেটে হামলার পর ইরান–ইসরায়েল উত্তেজনা নতুন মোড় নিয়েছে
সিরিয়ায় কনস্যুলেটে হামলার পর ইরান–ইসরায়েল উত্তেজনা নতুন মোড় নিয়েছে

মতামত

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনায় কেন জড়াতে চায় না সৌদি আরব ও আমিরাত

চলতি মাসের শুরুতে দামেস্কে তেহরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলি বিমান হামলার প্রতিশোধ হিসেবে গত সপ্তাহে ইরান ইসরায়েলকে নিশানা করে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। এই ঘটনাপ্রবাহ মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত ইরান-ইসরায়েলের ‘ছায়া যুদ্ধ’ শেষ হয়েছে এবং তারা এখন সরাসরি ‘রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্র’ সংঘর্ষে জড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

গাল্‌ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) ছয়টি সদস্যদেশ এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলের জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে নড়বড়ে করে দেওয়ার মতো সহিংস প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। একমাত্র বাহরাইন ছাড়া জিসিসির বাকি সব সদস্য সিরিয়ায় ইরানের কূটনৈতিক স্থাপনায় ইসরায়েলের বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছিল। অবশ্য একমাত্র কুয়েত নিন্দা জানানো বিবৃতিতে ইসরায়েলের নাম উল্লেখ করেছিল।

অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সময় সম্ভবত এমনভাবে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছে, যাতে তাদের ইরানের নেতৃত্বাধীন ‘প্রতিরোধ জোট’-এর শ্রেণিভুক্ত বা সেই সারির দেশ মনে না হয়। ইরানি কনস্যুলেটে হামলার ১২ দিন পর তেহরান সাহসী প্রত্যাঘাত করার পর জিসিসি দেশগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং (তাৎক্ষণিকভাবে ইরানকে নিন্দা না করে) উত্তেজনা কমাতে উভয় পক্ষের প্রতি আহ্বান জানায়।

লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো, ইসরায়েলের দিকে ছোড়া ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার কাজে নিজের যুক্ত থাকার খবর দ্রুততার সঙ্গে সৌদি আরব প্রত্যাখ্যান করেছে। ইরান ও ইসরায়েলের উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে, তাতে মনে হচ্ছে, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের কার্যক্রমে কিংবা ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের কোনো কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়াবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

২০২০ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দুই বছর পর আবুধাবি ইরানের সঙ্গে পূর্ণমাত্রায় কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। এর কারণ আবুধাবি মধ্যপ্রাচ্যে একটি তুলনামূলক ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান ধরে রাখতে চায়। অন্তত ভূরাজনৈতিক বিষয় বিবেচনায় রেখে তারা একটি ক্রমবর্ধমান বহুমুখী ও জোটনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে চায়।

অন্যদিকে, ২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন অভিযান চালানোর পর দায়সারা গোছের প্রতিক্রিয়া দিয়ে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার একই ধরনের অবস্থানের জানান দিয়েছিল। ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বের এই সময়ও সৌদি আরব সেই জোটনিরপেক্ষ ধারায় হাঁটছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব উভয়ই তাদের তেল-পরবর্তী ভবিষ্যৎ অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে নিজেদের ব্যবসায় ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরতে চায়। এর জন্য তারা বিশ্বের একাধিক অঞ্চলকে নিজেদের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চায়।

আমাদের বুঝতে হবে, আমরা একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে আছি এবং যেকোনো সময় পরিস্থিতি দ্রুত ঘোরালো প্যাঁচালো হয়ে যেতে পারে। এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে ইসরায়েলে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পেছনে শুধু প্রতিরোধ মনস্তত্ত্ব কাজ করেনি। এর মধ্য দিয়ে তেহরান তার প্রতিবেশীদের কাছে নিজের অস্ত্রের পাল্লা ও নির্ভুলতা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠাতে চেয়েছে।

জিসিসি সদস্যরা নিজ নিজ দেশে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য এবং দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধি অর্জনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে। সে কারণেই তারা তাদের নিজস্ব সীমানার মধ্যে ও প্রতিবেশী এলাকাগুলোতে স্থিতিশীলতা চায়। ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার রিসার্চ ফেলো ও আমিরাতি সমাজবিজ্ঞানী মিরা আল-হুসেনের মতে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব ‘তাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সর্বোচ্চ মন দিয়েছে।’

এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে কাতারের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ শেখ নওয়াফ বিন মুবারক আল-থানি বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধের আলোকে আমি মনে করি, জিসিসি দেশগুলোর বেশির ভাগের জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো, তারা যদি আরেকটি ‘অন্তহীন যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাদের প্রাপ্তির চেয়ে খরচের পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যাবে।’

অনেকেই যখন ইরান ও ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে সাজানো প্রচারণা বলে ভাবতে শুরু করেছেন, তখন উপসাগরীয় এলাকা ও জর্ডানের অনেক বিশ্লেষক ইরানের ১৩ এপ্রিলের হামলাকে দৃষ্টি আকর্ষক নাটকীয়তা বলে মনে করছেন। তাঁরা মনে করছেন, এই হামলা ইরান ও ইসরায়েল উভয়েরই ভাষ্যকে জোরালো করার কাজ করেছে।

সেই জায়গা থেকে দেখলে বলা যায়, ইরানের ইসরায়েলবিরোধী পদক্ষেপগুলো না গাজাকে অস্ত্রবিরতির কাছাকাছি এনেছে; না ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের মর্যাদাপ্রাপ্তির দিকে নিয়েছে। বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, এই হামলা অত্যন্ত ভয়ংকর ছিল।

রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের যে নতুন সূচনা হয়েছে, ইরান-ইসরায়েলের এই শত্রুতায় তা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটিও এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। সৌদি আরব যেসব কারণে গত বছর ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে আগ্রহী হয়েছিল, তার সবই সৌদি আরবের জন্য এখন পর্যন্ত অপরিবর্তনীয় আছে। ইরানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান শত্রুতা সম্পর্কে রিয়াদের ভারসাম্যপূর্ণ ও পরিমিত প্রতিক্রিয়া এবং ইয়েমেনে হুতি লক্ষ্যবস্তুতে ইঙ্গো-মার্কিন বোমাবর্ষণ থেকে নিজেকে দূরে রাখার দৃঢ় সংকল্প প্রমাণ করে, তেহরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে রিয়াদের প্রতিশ্রুতি এখনো দৃঢ় অবস্থায় আছে। তবে এটিও ঠিক, ইরান এবং সৌদি রাজবংশের সঙ্গে শত্রুতার দীর্ঘ ইতিহাস আছে, তেহরান ঘনিষ্ঠ এমন অরাষ্ট্রীয় আরব গ্রুপগুলো সম্পর্কে সৌদি আরব আগের মতোই সন্দেহ পোষণ করে যাচ্ছে।

আঞ্চলিক উত্তেজনা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে ‘প্রতিরোধ জোট’ভুক্ত ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠী কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এবং তাদের কর্মকাণ্ড জিসিসি সদস্যদের নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে, সে বিষয়টি রিয়াদের নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে।

আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ইস্যুগুলো সৌদি-ইরান গাঁটছড়া বাঁধার প্রক্রিয়াকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দেবে। তবে ইসরায়েল এখন কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেবে, তার ওপর মূলত সবকিছু নির্ভর করছে। আল-থানি বলেছেন, যদি ইসরায়েলিরা সংযম দেখায় (সেটি সীমিত আকারের সামরিক অভিযানের মাধ্যমে হোক কিংবা ন্যূনতম হতাহতের মাধ্যমে হোক), সে ক্ষেত্রে সৌদি-ইরানি সম্পর্কের বিদ্যমান ধারা অপরিবর্তিত থাকবে।

তবে আমাদের বুঝতে হবে, আমরা একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে আছি এবং যেকোনো সময় পরিস্থিতি দ্রুত ঘোরালো প্যাঁচালো হয়ে যেতে পারে। এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে ইসরায়েলে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পেছনে শুধু প্রতিরোধ মনস্তত্ত্ব কাজ করেনি। এর মধ্য দিয়ে তেহরান তার প্রতিবেশীদের কাছে নিজের অস্ত্রের পাল্লা ও নির্ভুলতা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠাতে চেয়েছে।

একই সঙ্গে তারা জিসিসিকে দেখাতে চেয়েছে, ইসরায়েলের নিরাপত্তার বিষয়ে ওয়াশিংটনের প্রতিশ্রুতিকেও তারা চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

● জর্জিও ক্যাফিরো ওয়াশিংটনভিত্তিক ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি পর্যালোচনা–সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান গাল্‌ফ এস্টেট অ্যানালিটিকসের প্রধান নির্বাহী

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ