বিসিএস ভাইভাতে ২০০ নম্বরের বিধান কতটা যৌক্তিক

গত সপ্তাহে রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিফেন্স বোর্ডে আমি একজন পরীক্ষক হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলাম। ওই বোর্ডে অন্য দুজন সম্মানিত পরীক্ষকের সঙ্গে আলাপকালে বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে তাঁদের উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতা শুনছিলাম।

সম্মানিত দুজন শিক্ষকই একাধিকবার বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন। তাঁরা আলাপকালে জানান, দুজনকেই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তি বোর্ডে ঢোকার আগমুহূর্তে সুপারিশ করেছিলেন তাঁর পছন্দের প্রার্থীকে ২০০ নম্বরের ভেতর অন্তত ১৯০ দেওয়ার জন্য। সাধারণত ১৯০ নম্বর পাওয়া প্রার্থীকে এক্সট্রা–অর্ডিনারি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এমন নম্বর পেলে প্রার্থী তাঁর পছন্দমতো ক্যাডার পেয়ে যেতে পারেন—এটি অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে এমনও হতে পারে যে ওই বিসিএস পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম স্থান লাভ করতে পারেন। কারণ, যাঁরা লিখিত পরীক্ষায় ভালো করেন, তাঁদেরই মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। এমনও পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যে একজন প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার নম্বর অন্য প্রার্থীদের প্রায় কাছাকাছি। ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায়, দশমিকের পরে সামান্য কিছু সংখ্যার তারতম্যের কারণেও প্রার্থীর মেধাক্রম কিংবা পছন্দক্রম নির্ধারিত হতে পারে।

বিসিএস পরীক্ষায় কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করার পর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। দীর্ঘদিনে প্রস্তুতির পর প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়। ১০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট চাকরিপ্রার্থীর। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় ক্যাডার হওয়া কিংবা না হওয়াও নির্ভর করে মৌখিক পরীক্ষার নম্বরের ওপর।

বিসিএস পরীক্ষায় কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করার পর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। দীর্ঘদিনে প্রস্তুতির পর প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়। ১০ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে ফলাফল নির্ধারিত হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট চাকরিপ্রার্থীর। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় ক্যাডার হওয়া কিংবা না হওয়াও নির্ভর করে মৌখিক পরীক্ষার নম্বরের ওপর।

লিখিত পরীক্ষায় প্রথম সারির ফল থাকলেও মৌখিক পরীক্ষায় কোনো কারণে বোর্ডকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট চাকরিপ্রার্থীর কপালে নেতিবাচক ফলের নজিরও সৃষ্টি হতে পারে; কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে যে দীর্ঘ প্রস্তুতি এবং অনেকগুলো পরীক্ষার পর অপেক্ষাকৃত একটি অল্প সময়ের মৌখিক পরীক্ষায় সত্যিকার অর্থেই কি প্রার্থীকে যথাযথভাবে বিচার করা যায়?

অনেকেই প্রশ্ন তোলেন—মৌখিক পরীক্ষায় ২০০ নম্বর অযৌক্তিক। এর যৌক্তিকতা আছে কি না। এমন প্রশ্ন পিএসসিকে ছুড়ে দিলেও সেখান থেকে সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যাবে কি না, সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অনেকেই দাবি করেন, মৌখিক পরীক্ষা কখনো মেধাবী নির্ণয়ের মাপকাঠি হতে পারে না। এটি অনেক সময় ভাগ্য হিসেবেও দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার জন্য।

এমন অনেক চাকরিপ্রার্থী রয়েছেন, যাঁরা লিখিত পরীক্ষায় অনেক বেশি নম্বর পেলেও অন্য বিশেষ কোনো কারণে মৌখিক পরীক্ষায় ভালো নম্বর পান না। কারণ, অনেক প্রার্থী যাঁরা সারা জীবন শুধু বই পড়েছেন; কিন্তু অন্য গুণাবলি—স্মার্টনেস, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা, বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সক্ষমতা প্রভৃতি বিষয় তাঁদের মধ্যে কিছুটা অনুপস্থিত থাকতে পারে। এমনকি প্রার্থীর প্রত্যাশার কারণে মৌখিক পরীক্ষায় নার্ভাস হয়ে পড়তে পারেন।

এতে দেখা যায় যে মৌখিক পরীক্ষায় অন্যদের তুলনায় কম নম্বর পেয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী ক্যাডারই হতে পারবেন না। আবার কোনো প্রার্থী তাঁর বোর্ডে নিজ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা নিজ জেলার বোর্ডের সদস্য পেয়ে যেতে পারেন। ফলে না চাইতেও তাঁর প্রতি সফটকর্নার বা সহানুভূতি তৈরি হলে অন্য মেধাবীদের পিছিয়ে পড়ার সুযোগ হতে পারে। তা ছাড়া বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের দেশে স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি কিংবা সুপারিশ কালচার বিদ্যমান।

অবশ্য অনেকেই মনে করেন, ২০০ নম্বর মৌখিক পরীক্ষায় থাকার বিষয়টি যৌক্তিক। এর কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে কয়েকটি দিক। প্রার্থীর জ্ঞানের গভীরতা, পরিস্থিতি সামলানোর দক্ষতা ও যোগ্যতা, উপস্থিত বুদ্ধি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং পোশাক থেকে শুরু করে কথা বলা—সব ক্ষেত্রে শালীনতা এবং ভদ্রতা প্রভৃতি।

গত বছর পিএসসির চেয়ারম্যানের একটি বিবৃতি থেকে জানতে পারি, বিসিএসের বোর্ডে জেলা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞাসা করা হবে না। পরবর্তী সময়ে সেটি বাস্তবায়িত হয়েছে কি না, কিংবা বাস্তবায়ন করা হবে কি না, সে বিষয়ে আমার জানা নেই। উল্লিখিত বিবৃতিতে পিএসসির চেয়ারম্যান বলেছিলেন, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রার্থী পেলে বা জেলার প্রার্থী পেলে অনেক পরীক্ষক পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন; যা প্রার্থীর জন্য সুবিধাজনক ক্ষেত্র সৃষ্টি করে বলে মনে করে পিএসসি (ডিবিসি নিউজ, ১৫ জানুয়ারি ২০২৩)।

তাঁর এই বক্তব্যে এটি স্পষ্ট হয় যে পিএসসিতে এমন পক্ষপাতমূলক আচরণের ঘটনা ঘটে এসেছে। এমন পক্ষপাতমূলক আচরণ থাকা সত্ত্বেও বিসিএস মৌখিক পরীক্ষায় আগে প্রচলিত ১০০ নম্বরের পরিবর্তে ২০০ নম্বরের বিধান চালু করার বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্দেশ্যমূলক। প্রার্থীকে ভালোভাবে যাচাই করার যুক্তি দিয়ে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ১০০  থেকে বাড়িয়ে ২০০ করার মাধ্যমে অনিয়মের দুয়ার আরও চওড়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করে বলা যায়।

এমনও দেখা যায়, বোর্ডে বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে রাজধানীকেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বেশি রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও সেখান থেকে খুব বেশি বিশেষজ্ঞ–সদস্য হিসেবে মনোনীত করার নজির চোখে পড়ে না।

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা নিয়ে অনেক দিন ধরেই বিতর্ক চলছে। চাকরিপ্রার্থীদের অভিযোগ, এতে বিশেষ কোনো প্রার্থী সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। এমনকি বলা যায়, গুরুতর অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এই ২০০ নম্বরে।

বর্তমানে বোর্ড সদস্যরা প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষার ফল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম এবং জেলার নাম জানতে না পারলেও অন্য কোনো বিশেষ উপায়ে জানতে পারলে ফলাফলে এর প্রভাব পড়তে পারে—এতে কোনো সন্দেহ  নেই। বিশেষ করে প্রশ্ন থেকে যায়—আমি যে ঘটনা উল্লেখ করে এই লেখা শুরু করেছি, তেমনভাবেও অর্থাৎ উদ্দেশ্যমূলকভাবেও পিএসসির সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বোর্ড সদস্যদের কাছে তথ্যসহ সুপারিশ করতে পারবেন। আর এভাবেই ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর সংশ্লিষ্ট চাকরিপ্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণে করে দিতে পারে। যা তাঁর জীবনে সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যের কারণ হতে পারে।

  • ড. সুলতান মাহমুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। ই–মেইল: sultanmahmud.rana@gmail.com