সম্প্রতি তিস্তার ভাঙন দেখতে কুড়িগ্রামের কয়েকটি এলাকায় গিয়েছিলাম। অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে অসহায় অবস্থায় বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে ঘরের অবশিষ্টাংশে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও বাস করছেন।
রাজারহাট উপজেলার খেতাব খাঁ মৌজার বড় দরগায় হারুন অর রশিদের পরিবারের একর দুয়েক জমি দুই বছরে নদীতে বিলীন হয়েছে। কয়েক দিন আগে বৃষ্টিমুখর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, একটি ঘর ছাড়া সবই নদীর পেটে চলে গেছে। ঘুমিয়ে থাকলে স্ত্রী–সন্তানসহ তাঁর সলিলসমাধি হয়ে যেত। পরিবার নিয়ে তীর ঘেঁষে ঘরের অবশিষ্টাংশে থাকেন এখন। আগেও একবার তাঁদের বাড়ি খেয়েছে নদী। তখন বাবা–ভাইয়েরা বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছেন। তিস্তা ঘেঁষে একমাত্র ঘরটিতে থাকতে ভয় হয় কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে হারুনের স্ত্রী জাহানারা বেগম বলেন, ‘ভয় কল্লে আর কী করমো। উপায় তো নাই। টাকা নাই বাড়ি করার।’
বাড়ি ভেঙে গেলে এনজিওর কিস্তি দিতে হয় কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে সবাই একবাক্যে বললেন, কিস্তি দিতেই হবে। একজন বলেন, ‘বাপ মরি গেইলেও কিস্তি দেওয়া নাগবে।’ যাঁদের বাড়ি ভেঙে যায়, তাঁদের সরকার বাড়িঘর-জমির ব্যবস্থা করে দেয় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তাঁরা সমস্বরে বলেন, ‘কোনো দিন নদীভাঙা মানুষের বাড়ি সরকার করে দেয় না।’
তোজাম্মেল হকের বড় সুপারিবাগান ছিল। লাখ লাখ টাকার সুপারি বিক্রি হতো এক বছরেই। সেই বাগান এখন নদীতে বিলীন। ছয়টি ঘর ছিল, এখন একটির অবশিষ্ট আছে। ছেলে পার্শ্ববর্তী একটি জমিতে নতুন ঠিকানা গড়েছেন। তোজাম্মেলের ঘরের অবশিষ্টাংশের পাশে ইউসুফের বাড়ি। তাঁর চারটি ঘরের মধ্যে একটির অবশিষ্ট আছে। ইউসুফ ঘর ছেড়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকা চলে গেছেন।
বাড়ি ভাঙলে উদ্বাস্তু মানুষের কষ্টের শেষ থাকে না। খুব অল্পসংখ্যক মানুষ আছেন, যাঁরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। অধিকাংশই চরম বিপদে পড়েন। কেউ অন্যের বাড়িতে আশ্রিত হন। কেউ জমি কিনে ঘর তোলেন। কেউবা জমি ভাড়া নেন। জানলাম, বাড়ি ভেঙে একজন বাস্তুহারা ৯ শতক জমি ৭৫ হাজার টাকায় ৫ বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছেন। সুদ কারবারির কাছে ৫০ হাজার টাকা নিয়ে ভাড়ার টাকা পরিশোধ করেছেন। বছরে সুদ বাবদ তাঁকে ১০ মণ ধান দিতে হবে। ধান দিতে না পারলে ওই ১০ মণ ধানের মূল্য নির্ধারণ করে সেটি পরের মৌসুমের জন্য সুদযোগ্য বলে গণ্য হবে।
বাড়ি ভেঙে গেলে এনজিওর কিস্তি দিতে হয় কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে সবাই একবাক্যে বললেন, কিস্তি দিতেই হবে। একজন বলেন, ‘বাপ মরি গেইলেও কিস্তি দেওয়া নাগবে।’ যাঁদের বাড়ি ভেঙে যায়, তাঁদের সরকার বাড়িঘর-জমির ব্যবস্থা করে দেয় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তাঁরা সমস্বরে বলেন, ‘কোনো দিন নদীভাঙা মানুষের বাড়ি সরকার করে দেয় না।’ তিস্তা রেলসেতুর কয়েক শ গজ ভাটিতে বছর দশেক আগে সড়কসেতু হয়েছে। অনেকেই বলেছেন, অপরিকল্পিত মাপের এই সেতুর কারণে নদীর উত্তর দিকে ভাঙন বেড়েছে।
বর্ষা মৌসুম মানেই তিস্তায় বন্যা আর ভাঙন। সরকার কখনোই ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। প্রতিবছর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে জানা যায়, ভাঙনপ্রবণ ৩২ কিলোমিটার এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধ করতে মাত্র ৬০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। সিসি ব্লক ফেলে সেই খরচ হবে এক হাজার কোটি টাকা। এই টাকা তিস্তা সুরক্ষায় কখনোই বরাদ্দ দেওয়া হয় না।
২০১৬ সালে এক চীনা প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় দেখা যায়, সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা হলে তিস্তা সুরক্ষায় স্থায়ী সমাধান সম্ভব। এর পর থেকে শুনে আসছি, সরকার এই টাকা ব্যয় করে সমীক্ষা ধরে প্রকল্প গ্রহণ করবে। সমীক্ষার পর ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিস্তার দুপাড়ে অন্তত সাত লাখ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অথচ মাত্র সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। এখন নিশ্চয়ই সেই খরচ আরও বেড়ে গেছে।
দেশের যখন আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, তখনই এই টাকার সংস্থান সম্ভব হয়নি। এখন এই টাকা বরাদ্দ পাওয়া আগের চেয়ে কঠিন বলেই মনে হয়। যদিও বর্তমান সরকার অনেক মেগা প্রকল্প নিয়েছে, যার একটিও আবার রংপুর বিভাগে নেই। অনেকেই মনে করেন, রংপুরের জন্য সরকার এত বড় প্রকল্প গ্রহণ করবে না। এ প্রকল্পকে ঘিরে আছে ভূরাজনৈতিক সংকট। ফলে তিস্তাকেন্দ্রিক এত বড় প্রকল্প শিগগিরই আলোর মুখ দেখবে—এ ভরসা করা কঠিন।
সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে রংপুরবাসীর মনে সংশয় তৈরি হয়, এ ঘোষণা আদৌ বাস্তবায়িত হবে কি? সেটি যদি হয়ও, প্রতিবছর লাখো কোটি টাকার ক্ষতি, তা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি? মাত্র এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেই তিস্তা নদীর ভাঙন অনেকটাই বন্ধ করা সম্ভব। বিজ্ঞানসম্মতভাবে ‘মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়নের আগে তিস্তার ভাঙন-বন্যা রোধেও ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
সরকারি উদাসীনতায় তিস্তাপারের মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর কষ্টের রেখা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ভাঙন-বন্যা কেবল তিস্তায় নয়, রংপুর অঞ্চলের বড় সব কটি নদীতে একই অবস্থা। ভাঙন ও বন্যা রোধ শতভাগ সম্ভব না হলেও সর্বোচ্চ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক