পাকিস্তানে অক্টোবরে নির্বাচন হবে বলে ইঙ্গিত মিলছে। তার আগে আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ‘নির্বাসন’ থেকে দেশে ফিরবেন। একসময় দুর্নীতির দায়ে বিচার শেষে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় অযোগ্য ঘোষিত হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তিনি। গত সপ্তাহে নির্বাচনী আইনের সংশোধন ঘটিয়ে ওই রায়ের অনেকখানি বদলে দেওয়া হলো, আর তাতে পরিষ্কার হলো নওয়াজের রাজনীতিতে ফেরার পথ। প্রশ্ন উঠেছে, পাকিস্তানে এই নাটকীয় অবস্থার ভবিষ্যৎ তাৎপর্য কী?
জেনারেল জিয়া-উল-হকের সহায়তায় রাজনীতিতে আসেন নওয়াজ শরিফ। তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
কখনো মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। শেষবার রীতিমতো রাজনৈতিক পরিসর থেকে পালাতে হয় তাঁকে।
জীবনে আর কখনো নির্বাচনে অংশ নিতে না পারার সিলমোহর পড়ে তাঁর জীবনবৃত্তান্তে ২০১৮ সালে।
কারাগারেও যেতে হয়। তবে ‘চিকিৎসা’র কথা বলে দেশের বাইরে গিয়ে জামিনের অপব্যবহার করে ২০২১ থেকে নওয়াজ লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সেনা মদদ ছিল বলে একদা তিনি নিজেই অভিযোগ তুলেছিলেন। কিন্তু ইমরান খানের সঙ্গে একই বাহিনীর টানাপোড়েন শুরু হওয়ামাত্র তাঁর ভাগ্য খুলতে শুরু করেছে আবার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নির্বাচনী আইন এমনভাবে সংশোধন করেছে যাতে নওয়াজের ‘আজীবন নির্বাচন থেকে দূরে’ থাকার বিধান ‘পাঁচ বছরে’ সীমিত হয়েছে। যেহেতু ২০১৮ সালে ওই রায় হয়, সুতরাং নওয়াজ ২০২৩ সালে এসে আবার নির্বাচনের যোগ্য হয়ে যাচ্ছেন! সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাঁর দল মুসলিম লিগের ব্যাপক বোঝাপড়া শেষে যে এমন ঘটল, সেটা পাকিস্তানের সবাই বুঝতে পারছে। নতুন নির্বাচনী বিধানের ‘সুবিধা’ নওয়াজ ছাড়াও পাবেন ইমরান খানের দল থেকে অনেক আগে চলে যাওয়া সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর তারিন। তিনিও ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে দুর্নীতির দায়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারা নির্বাচনী রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হন। পাকিস্তানের স্বাধীনচেতা বিচারপতিদের একাংশ মাঝে মাঝেই এ রকম রায় দিলেও ইমরানবিরোধী অবস্থান নেওয়ায় অন্য অনেকের মতো তারিনও এখন দেশটির সেনাবাহিনীর পছন্দের তালিকায় চলে এসেছেন। ফলে তাঁর নিষেধাজ্ঞাও আপাতত উঠে গেল।
কৌতূহলোদ্দীপক হলো কেবল দুজন ব্যক্তিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য নির্বাচনী আইনের এ রকম সংশোধনী এমন সময় পাস হলো যখন দেশটির প্রেসিডেন্ট হজে ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সাদিক সানজরানি দ্রুত বিতর্কিত বিলটিতে স্বাক্ষর করে দেওয়ায় অনুমান করা হচ্ছে, পুরো ব্যাপারটি ঘটেছে ব্যাপকভিত্তিক এক ‘সমঝোতা’র অংশ হিসেবে।
জুনের শেষ সপ্তাহে নতুন করে রাজনীতিতে ফেরার রাস্তা সুগম হওয়ামাত্র নওয়াজ লন্ডন থেকে দুবাই আসেন। সেখানে তাঁর জন্য হাজির ছিলেন পিপলস পার্টির (পিপিপি) নেতা আসিফ জারদারি, বিলওয়াল ভুট্টোসহ বহু রাজনীতিবিদ। নওয়াজের দলের জাভেদ লতিফ বেশ রসিকতা করে দেশবাসীর উদ্দেশে বললেন, ‘পাকিস্তান থেকে লন্ডনের বিমানদূরত্ব আট ঘণ্টা, আর দুবাইয়ে লাগে আড়াই ঘণ্টা।’ এ কথার প্রতীকী অর্থ হলো, নওয়াজ ধীরে ধীরে নিজ মাঠে ফিরছেন আবার। সময় ও দূরত্ব কমে আসছে।
শরিফ ও ভুট্টো বংশ মিলে বর্তমানে পাকিস্তানে সরকার চালাচ্ছে। শাসক জোটে এই দুই প্রধান শরিকের মাঝে আসন্ন নির্বাচন ও নির্বাচন-পরবর্তী সরকার নিয়ে অনেক বিষয়ে আলোচনা ও সমঝোতা হলো দুবাইয়ে। এসব দেখে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে আবারও চালকের আসনে ফিরলেন নওয়াজ শরিফ ও আসিফ জারদারি। অথচ এই দুজনের বিরুদ্ধে একসময় ব্যাপক দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ ছিল।
নওয়াজ ও জারদারি উভয়ে পাকিস্তানের অতিধনীদের তালিকায় একেবারে ওপরের দিকের মানুষ।
জাহাঙ্গীর তারিনও তা-ই। ২০১৭ সালে সরকারকে দেওয়া প্রকাশ্য হিসাবমতে, নওয়াজের সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ বিলিয়ন রুপি। একই সালে বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত ‘পানামা পেপার কেলেঙ্কারি’ নওয়াজ পরিবারের অপ্রকাশিত আরও সম্পদের বিবরণ জানায়। যার মধ্যে ছিল দুবাইয়ে নানা বিনিয়োগ। এসবই তিনি নির্বাচনী হলফনামায় যুক্ত করেননি। সুতরাং “এ রকম একজন ‘অসৎ’ ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারেন না” বলে সে সময় জানিয়েছিলেন বিচারপতি ইজাজ আফজাল খানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ।
আসিফ জারদারির বিরুদ্ধেও দুর্নীতির বিপুল অভিযোগ ছিল যখন তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পাকিস্তানের সমাজজীবনে তখন তাঁকে ‘মি. টেন পারসেন্ট’ বলা হতো। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগেও তিনি দুর্নীতির অভিযোগে জেলে ছিলেন। ২০২০ সালে তাঁর ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ ছিল ৭১৫ মিলিয়ন রুপি। পানামা পেপারসে জারদারির ঘনিষ্ঠ জাভেদ পাশার নামে পাঁচটি গোপন কোম্পানির নাম পাওয়া গেছে বিভিন্ন দেশে—যার সঙ্গে জারদারির সম্পদযোগ আছে বলে অনুমান করা হয়।
তবে এত সব অভিযোগ, প্রতিবেদন এবং মামলা-মোকদ্দমার পরও নওয়াজ ও জারদারির আবার রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা একটাই বার্তা দেয়, পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা থাকলে যেকোনো রাজনীতিবিদের জন্য ‘চারিত্রিক সনদ’ কোনো সমস্যা নয়।
ইমরানকে কোণঠাসা করতে গিয়ে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী গত এক বছর ব্যাপকভাবে জনরোষে পড়েছে। রাজনীতিতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপের অনেক কিছু সেখানে বেশ উদোম হয়ে গেছে জনগণের সামনে। এতে জেনারেলদের ভাবমূর্তিতে কিছু কালো দাগ পড়েছে। সেই ক্ষত শুকাতে হবে এখন তাঁদের। তার জন্যই রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে খানিক আড়ালে গিয়ে পুরোনো বেসামরিক সহযোগীদের আবার মোড়ক খুলে জনসমাজে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। জেনারেলরা জানেন, নওয়াজ-জারদারি-তারিনের মতো রাজনীতিবিদদের যেকোনো সময় নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে না।
আবার এই রাজনীতিকেরাও জানেন সেনাবাহিনী ইমরানের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে যেসব ভুল করেছে তার সুযোগ নিয়েই তাঁরা নিজেদের পুনর্বাসিত করতে পারছেন। অর্থাৎ সামরিক আমলাতন্ত্র ও পাকিস্তানের কুলীন সমাজ তাদের ৭৫ বছর পুরোনো সম্পর্কে ২০২৩ সালে যৌথ স্বার্থের আরেকটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করতে চলেছে। এ অবস্থার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইমরান খান গত ২ জুলাই খ্যাতনামা সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পাকিস্তানে এখন অঘোষিত সামরিক শাসন চলছে ’(ফ্রাইডে টাইমস, ২ জুলাই)।
কথাটা এই অর্থে মিথ্যা নয় যে সেনা স্থাপনা ভাঙচুরের দায়ে ইমরানের দলের অনেক কর্মীর বিচার শুরু হতে যাচ্ছে সামরিক আদালতে। এটা দেশের বিদ্যমান মূলধারার বিচারব্যবস্থার প্রতি একধরনের অবজ্ঞা কি না, সে প্রশ্ন আপাতত ইমরান ছাড়া কেউ তুলছেন না। তারপরও ইমরানের দাবিমতো অনেকে মানতে চাইবেন না পাকিস্তানে এখন সামরিক শাসন চলছে। উল্টো বলবেন, ইমরান খানের অপরিপক্ব রাজনৈতিক কৌশলই নওয়াজ ও জারদারিকে আবার রাজনীতির প্রধান চরিত্র হওয়ার সুযোগ করে দিল।
দুবাইয়ে যখন নওয়াজ ও জারদারি নির্বাচনকালীন লেনদেনের ছক কাটছেন, তখন একই সঙ্গে মামলা ও নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে দেশটির বিভিন্ন ‘সংস্থা’ ইমরানের পিটিআইয়ের রাজনীতিবিদদের দল ছাড়া করেছে। এদের যোগ দেওয়ানোর জন্য ইমরানের সাবেক প্রধান সহযোগী জাহাঙ্গীর তারিনকে নতুন দল (‘কিংস পার্টি’!) গড়তে দেওয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগের মিলিত ফল হিসেবে আগামী অক্টোবর নাগাদ দুর্নীতিগ্রস্ত অতীতের প্রায় সব রাজনীতিবিদকে আবারও ভোট চাইতে দেখা যাবে দেশটিতে।
এর মধ্যে এমন ইঙ্গিতও মিলছে, সশস্ত্র বাহিনী সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলনামূলকভাবে এখনো দুর্নীতিগ্রস্ত নয় এমন একজনকে খুঁজছে। সেই তালিকায় পিপিপির বিলওয়াল ভুট্টো কিছুটা এগিয়ে। প্রধানমন্ত্রী পদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে ৩৫ বছর বয়সী বিলওয়ালকে এক বছর ধরে বিভিন্নভাবে ‘তৈরি করা’র কাজ চলছে। তবে পুরো প্রক্রিয়াটি দেশটির জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একধরনের ধোঁকাবাজির মতো।
পাকিস্তানের মানুষ চাইছে, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের আমূল সংস্কার। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কুলীন সমাজ হাতে হাত মিলিয়ে গত ৭৫ বছর দেশটা শাসন করছে। জনগণ চাইছে এই সংস্কৃতির বদল। সেই চাওয়ার পার্শ্বফল হিসেবে ইমরান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। মানুষ ভেবেছিল তাঁর মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রশাসন পাওয়া যাবে। কিন্তু ইমরান আপাতত ক্ষমতার সমীকরণ থেকে ছিটকে গেলেন। তাঁকে অনিশ্চিত অপেক্ষায় থাকতে হবে কিছুকাল। চারদিক থেকে ইমরানকে কোণঠাসা করে দেশটির ‘ডিপ স্টেইট’ আবার তাদের বশংবদ পুরোনো চরিত্রগুলোকে ত্রাণকর্তা হিসেবে সামনে নিয়ে এল। পাকিস্তান তার রাজনৈতিক দুর্ভাগ্যের গোলকধাঁধা থেকে এবারও নিষ্কৃতি পাচ্ছে বলে মনে হয় না।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক