মতামত

প্রিগোশিনের ভূত পুতিনকে তাড়া করে ফিরবে

ইয়েভগেনি প্রিগোশিন
ইয়েভগেনি প্রিগোশিন

ইয়েভগেনি প্রিগোশিন দৃশ্যত মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর ভূত সম্ভবত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ঘুমে-জাগরণে তাড়া করে ফিরবে। প্রিগোশিন হলেন সেই লোক, যাঁকে পুতিন বিশ্বাসঘাতক সাব্যস্ত করে সরিয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু চেষ্টা করেও পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধ প্রশ্নে প্রিগোশিনের সমালোচনাকে নিভিয়ে দিতে পারেননি।

বুধবার বিমান দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের তালিকায় প্রিগোশিনের অন্তর্ভুক্তি পুতিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চ পরিষ্কার করে দিয়েছে। কিন্তু প্রিগোশিনের মৃত্যুর এই খবর (জল্পনা আছে, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে) অনেক রাশিয়ানের মধ্যে এই ধারণার জন্ম দেবে যে রাশিয়া স্তালিনের সময়কার নৃশংস রাজনীতির সঙ্গে মিশ্রিত একটি অস্থিতিশীলতার দিকে ফিরে গেছে।

কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্তোয়ানোয়া বলেছেন, ‘তাঁর (প্রিগোশিন) সঙ্গে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, রাশিয়ার অভিজাত গোষ্ঠী এই ঘটনাকে প্রতিশোধমূলক কাজ হিসেবেই দেখবে।’ তিনি বলেন, ক্রেমলিন চাইছে সবার মধ্যে এই বোধটাই তৈরি হোক যে পুতিন প্রতিশোধ নিয়েছেন।

সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম জে বার্নস গত মাসে অ্যাসপেন সিকিউরিটি ফোরামে এনপিআরের মেরি লুইস কেলিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘পুতিন প্রতিহিংসার চূড়ান্ত প্রতিভূ’। সেই দিক থেকে বলা যায়, রাশিয়ার মানুষ ধরে নেবে, এই প্রাইভেট বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে পুতিনের হাত ছিল।

এই দুর্ঘটনাবিষয়ক তথ্য যখন নিশ্চিত হবে, ততক্ষণে পুতিন তাঁর অবস্থান সংহত করে ফেলবেন এবং তিনি যে ব্যক্তিকে ‘সশস্ত্র বিদ্রোহের’ জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন, তিনি ততক্ষণে আলোচনার বাইরে চলে যাবেন।

ইউক্রেনে কিয়েভের বিরুদ্ধে রুশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এখন পুরোমাত্রায় সক্রিয় রয়েছে। দুই মাস আগে যখন প্রিগোশিন তাঁর ভাগনার মিলিশিয়াকে মস্কোর দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, তখন পুতিনের অবস্থানকে যতটা নড়বড়ে মনে হচ্ছিল, এখন সেই অবস্থানকে অনেক বেশি দৃঢ় বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু এটি নিশ্চিত যে পুতিনের রাজনৈতিক আধিপত্যের আভা কলঙ্কিত হয়েছে এবং সম্ভবত সেই ক্ষতিটা অপূরণীয়ভাবেই হয়েছে। রাশিয়ার অভিজাতদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার এবং নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণের খ্যাতির কারণে পুতিন অতীতে বহু ঝড় মোকাবিলা করেছেন।

প্রিগোশিনের বিদ্রোহ এই দুটি বিষয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রিগোশিনের সমালোচনার রেশ ধরে পুতিনের নিজস্ব বলয়ের কিছু সদস্যও ইউক্রেনে পুতিনের আবেগতাড়িত আক্রমণ ও তাঁর যুদ্ধকৌশলের সমালোচনা করেছেন। বিশ্লেষকেরা বিশ্বাস করেন, পুতিনের শক্তি ও কৌশল সম্পর্কে প্রিগোশিন রাশিয়ার মানুষের মধ্যে যে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তা রাশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীতেও সংক্রমিত হয়েছে। বিমান দুর্ঘটনার পরপরই প্রিগোশিনের মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে গোনা কিছু সদস্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি ‘মস্কো অভিমুখে যাত্রা’র আয়োজন করার হুমকি দিয়েছেন।

এটি ঠিক, তাঁদের হাতে সত্যি সত্যি মস্কো অভিযানের বিশ্বাসযোগ্য হুমকি দেওয়ার মতো সেনা নেই। তবে পুতিনের এই প্রয়াত প্রতিদ্বন্দ্বীর অন্তর্ধান রাশিয়ার রাজনৈতিক উদ্বেগকে কমিয়ে না দিয়ে বরং আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

রাশিয়ার ওপর যাঁরা নজর রাখছেন, তাঁরা খেয়াল করেছেন, পুতিনের ঘনিষ্ঠ অভিজাত বলয়ের অনেকেই তাঁর হঠকারী সিদ্ধান্তের বিষয়ে পলায়নপর মনোভাব দেখাতে শুরু করেছেন।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে বেপরোয়া সর্বাত্মক আক্রমণ তার সবচেয়ে বড় চমকপ্রদ উদাহরণ। পুতিন তখন থেকেই নানাভাবে বিভ্রান্ত হয়েছেন। শিগগিরই যুদ্ধের সমাপ্তি হচ্ছে না—এটি স্পষ্ট হওয়ার পরও তিনি রুশ সেনা সমাবেশ ঘটাতে দেরি করেছিলেন। তিনি খেরসনের চূড়ান্ত পতনের লক্ষণ দেখার পরও অবরুদ্ধ এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবেন কি না, তা নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন এবং প্রিগোশিন বিদ্রোহ ঘোষণা করার পর পুতিন সিদ্ধান্তমূলকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পুরো একটি দিন সময় নিয়েছিলেন।

জুনে প্রিগোশিন বিদ্রোহ শুরু করার পর পুতিনের সিদ্ধান্তহীনতা নিয়ে রুশ জনসাধারণ যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল, সে বিষয়ে সিআইএ পরিচালক বার্নস বলেছেন, যেন রুশ জনগণ প্রশ্ন করছে, ‘রাজার গায়ে কি কোনো কাপড় নেই?’

কূটাভাষ হলো এই, পুতিন পুনরায় ক্ষমতা সংহত করায় সম্ভবত ইউক্রেনের উত্তেজনাকে কমিয়ে দিয়েছে। গত বছরান্তে খারকিভ ও খেরসনে রুশ বাহিনী যখন বিধ্বস্ত হচ্ছিল, তখন বিশ্লেষকেরা একটি বাস্তব ঝুঁকি দেখেছিলেন যে তিনি একটি বিপর্যয়কর পরাজয় এড়াতে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে বসতে পারেন। কিন্তু এখন সেই বিপদ অনেকটাই কমে এসেছে।

বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতির জন্য চীনের সাহায্য উত্তরোত্তর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

চীনারা সরাসরি অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করছে না; কিন্তু তারা আগ্নেয়াস্ত্র ও ড্রোনের জন্য অপরিহার্য চিপের চালান বাড়াচ্ছে বলে বলা হচ্ছে।

ওয়াশিংটনের যে ধারণার বিষয়ে সবাই একমত হচ্ছে, সেটি হলো এ বছর কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের সেনারা থাবা বসাতে পারবে না, যেমনটা তারা আশা করেছিল। তবে কিছু মার্কিন কর্মকর্তা মনে করেন, ইউক্রেনের ধারাবাহিক আঘাত রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে অনেক বড় ধাক্কা দেবে। ইউক্রেন রুশ প্রতিরক্ষার প্রথম স্তরগুলো লঙ্ঘন করার কারণে রাশিয়ান প্রতিরোধ ভঙ্গুর প্রমাণিত হতে পারে।

প্রিগোশিন যে বার্তা দিয়ে গেছেন, তা হলো পুতিনের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে রুশ জাতিকে রক্ত ও সম্পদ খরচ করতে হচ্ছে। তিনি সরাসরি পুতিনের দল এমনকি পুতিনের নেতৃত্ব নিয়ে যৌক্তিক প্রশ্ন তুলে গেছেন। এটি বহুদিন পর্যন্ত পুতিনকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে।

ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত

  • ডেভিড ইগনেটিয়াস ওয়াশিংটন পোস্ট–এর নিয়মিত কলাম লেখক