তীর্থযাত্রীর বেশে গিয়ে সৌদি আরবে ভিক্ষা করা পাকিস্তানে খুব সাধারণ এক ব্যাপার। এই সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে ইদানীং সৌদি আরব রাষ্ট্রীয়ভাবে পাকিস্তান সরকারের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে তা থামানোর জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। অনুরোধের ভাষা অবশ্য খুব নরম ছিল না। সৌদি কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে জানিয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে তা পাকিস্তান থেকে যাওয়া হাজিদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
সরকার অন্য দেশ আর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা ধার চাইছে ঘন ঘন। দেশের রাজনৈতিক বয়ানে এখন ‘ভিক্ষা চাওয়া’ একটা পরিচিত বহুল ব্যবহৃত শব্দ হয়ে গেছে।
পাাকিস্তানের ধর্ম মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। মন্ত্রণালয় ‘ওমরাহ অ্যাক্ট’ চালু করবে। তারা হজে যারা লোক পাঠানোর ব্যবস্থাপনায় কাজ করে, সেই সব ট্রাভেল এজেন্সিকে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনবে।
সৌদি রাষ্ট্রদূত নাওয়াফ বিন সাইদ আহমদ আল-মালকির সঙ্গে এক সাক্ষাতে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নকভি এর জন্য দায়ী মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
পররাষ্ট্রসচিব জুলফিকার হায়দার সিনেট প্যানেলকে জানান যে সারা পৃথিবীতে ভিক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়া মানুষের মধ্যে ৯০ শতাংশ পাকিস্তানের নাগরিক। পবিত্র নগরীতে পকেটমার যারা ধরা পড়ে, তাদেরও বড় অংশ পাকিস্তানের।
হায়দার আরও বলেছিলেন, ‘ইরাক, সৌদি আরব লাগাতার অভিযোগ জানাচ্ছে যে আমরা তাদের দেশে অপরাধী পাঠাচ্ছি। ওদের দেশের কারাগার পাকিস্তানি ভিক্ষুকে ভর্তি হয়ে গেছে।’
সরকার দেশের বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থায় বিদেশের কাছে সাহায্য চায়। এটা মোটামুটি স্বীকৃত এক পন্থা। পাকিস্তানের অর্থনীতি এখন খুব বেকায়দায় আছে। সরকার অন্য দেশ আর আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা ধার চাইছে ঘন ঘন। দেশের রাজনৈতিক বয়ানে এখন ‘ভিক্ষা চাওয়া’ একটা পরিচিত বহুল ব্যবহৃত শব্দ হয়ে গেছে।
২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘আজ যখন কোনো বন্ধুদেশে যাই বা তাদের ফোন করি, তারা ভাবে টাকা ভিক্ষা চাইতে এসেছি।’
পাকিস্তান সরকার যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ঋণ বা অর্থ সাহায্য চাইছে, তখন দেশে ভিক্ষাবৃত্তি হয়ে উঠেছে সুসংগঠিত এক শিল্প। দেশের সম্ভাব্য সব জায়গায় ভিক্ষুকদের দাপট। এমনকি পরিকল্পিতভাবে ভিক্ষুক রপ্তানিও হচ্ছে। অবশ্য তা বেসরকারি মাফিয়া উদ্যোগের মাধ্যমে।
বিদেশগামী পাকিস্তানি ভিক্ষুকদের প্রাথমিক গন্তব্য সৌদি আরব। এরপর ইরান ও ইরাক। এখন তাদের নতুন পছন্দ জাপান।
খুব আকর্ষণীয় এই রোজগার কেবল দেশের ভেতরের হিসাব। এই একই প্রতিবেদন জানাচ্ছে যে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আড়াই বছরে সৌদি আরবের মতো দেশ থেকে পাকিস্তান সরকার ৪৪ হাজার ভিক্ষুককে ফিরিয়ে এনেছে। ভিক্ষা করতে গিয়ে চিহ্নিত হয়েছে এমন নাগরিকদের কম্পিউটারাইজড ন্যাশনাল আইডেনটিটি কার্ড ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। দুই হাজার চিহ্নিত ভিক্ষুকের পাসপোর্ট সাত বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
ভিক্ষুকেরা প্রতিদিন ৩২ বিলিয়ন রুপি সংগ্রহ করে ভিক্ষা থেকে। বছর শেষে এই পরিমাণ দাঁড়ায় বিস্ময়কর, প্রায় ১১৭ ট্রিলিয়ন রুপি! মার্কিন ডলারে ৪২ বিলিয়ন ডলার। আর এই অর্থ দেশের মোট জিডিপির ১২ শতাংশ!
পাকিস্তানের সেন্টার ফর বিজনেস অ্যান্ড সোসাইটি এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অদক্ষ শ্রমের চেয়ে ভিক্ষা করলে লাভ হয় অনেক বেশি। ২৩ কোটি জনসংখ্যার দেশে ৩ কোটি ৮০ লাখ লোকের ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করা খুব লাভজনক। করাচি শহরে ভিক্ষুকদের প্রতিদিন গড় আয় প্রায় ২ হাজার রুপি। লাহোরে ১ হাজার ৪০০ রুপি আর ইসলামাবাদে ৯৫০ রুপি। দেশে অদক্ষ শ্রমিক এর ধারেকাছেও রোজগার করতে পারে না।
পাকিস্তানের পত্রিকা ‘ডন’ জানাচ্ছে যে এই ভিক্ষুকেরা প্রতিদিন ৩২ বিলিয়ন রুপি সংগ্রহ করে ভিক্ষা থেকে। বছর শেষে এই পরিমাণ দাঁড়ায় বিস্ময়কর, প্রায় ১১৭ ট্রিলিয়ন রুপি! মার্কিন ডলারে ৪২ বিলিয়ন ডলার। আর এই অর্থ দেশের মোট জিডিপির ১২ শতাংশ!
এই পরিমাণ অর্থ কিছু না করেই রোজগার করছেন দেশের ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। দেশে যে ২১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি, তাতে এই ঘটনার অবদান আছে, তা আর বলে দিতে হয় না। ভিক্ষুকের সংখ্যা নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশা আছে। এশিয়ান মানবাধিকার কমিশন জানাচ্ছে, এই সংখ্যা ৫০ লাখ থেকে আড়াই কোটি পর্যন্ত হতে পারে। তার মানে মোট জনসংখ্যার ২.৫ থেকে ১১ শতাংশ! বড় শহরগুলোর রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়ায় প্রায় ১২ লাখ শিশু।
শুধু করাচি শহরেই ভিক্ষুকের সংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজার। প্রতি রমজান মাসে গড়ে নতুন ভিক্ষুক আসে আরও ৩ লাখ।
বিভিন্ন তীর্থস্থানে যাওয়ার রেওয়াজ আছে উপমহাদেশে। পাকিস্তানেও তা–ই। সেখানে দান-ধ্যান করা প্রথার মধ্যে পড়ে। তবে পাকিস্তানে এই প্রথা ‘ভিক্ষা মাফিয়া’ চক্র গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিশু পাচার। ২০১০ সালেই বিবিসি জানিয়েছিল যে কেবল করাচি শহরেই ‘হারিয়ে গিয়েছে’ ৩ হাজার শিশু।
ভিক্ষা ব্যবসা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটের মতোই পুরোনো। ২০১০ সালে পাকিস্তানের ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার এক সমীক্ষা চালায়। সেখানে উঠে আসে যে ৫৮ শতাংশ ভিক্ষুক ভিক্ষা ছেড়ে কোনো বিকল্প পেশায় যেতে আগ্রহী নয়। এদের ২৪ শতাংশ কাঠের কাজ, জুতা তৈরি, দরজির কাজ ইত্যাদিতে দক্ষ। তাদের বড় অংশের বয়স ২০ থেকে ৪০–এর মধ্যে।
ভিক্ষা যে কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে, তার এক নজির দেখা গেছে এ বছরের এপ্রিল মাসে। করাচি আদালত একজন ভিক্ষুকের আবেদন নাকচ করেন। একজন নারী ভিক্ষুক অন্য চারজন ভিক্ষুকের বিরুদ্ধে এফআইআর দাখিল করেছিলেন। তাঁরা চারজন পিস্তল ঠেকিয়ে বাদীকে বাসস্টপেজের কাছের জায়গা ছেড়ে সরে যেতে হুমকি দিয়েছেন—এই অভিযোগে। পুলিশ তদন্ত করে দেখে যে উভয় পক্ষ একে অপরের নামে একাধিকবার অভিযোগ দাখিল করেছে আগেও বেশ কয়েকবার।
যেকোনো অনুন্নত দেশের মতোই পাকিস্তানে আর যাই হোক আইনের কোনো অভাব নেই। ভিক্ষাবৃত্তি প্রতিরোধেও যথেষ্ট আইন আছে। ভিক্ষা করা সেখানে বেআইনি। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা পরাবে কে? ভিক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়লে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাবাসের বিধান আছে। তবে পুলিশ ভিক্ষার টাকায় চাঁদা নেয়। সঙ্গে আছে ভিক্ষা মাফিয়ার শক্ত হাত। আর এই ভিক্ষুকেরা ভিক্ষা না করলে করবে কী? সব মিলিয়ে আইন কাগজে–কলমেই বন্দী।
মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি ভিক্ষুক বড় পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনে। দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো এক দেশের অর্থনীতির জন্য এটা ফেলনা ব্যাপার নয়। দেশের সরকার এই ব্যাপারে যে পদক্ষেপ নিতে গড়িমসি করে, অনেকের মতে এটাও এর একটা কারণ।
ভিক্ষুকদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ পুলিশের ওপর আক্রমণ পর্যন্ত গড়ায়। ২০১১ সালে ফয়সালাবাদে কয়েক শ ভিক্ষুক ইটপাটকেল, লাঠি নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। একজন ভিক্ষুক সেই সময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘পাকিস্তানে ভিক্ষা করা অপরাধ হলো কবে? আমাদের সরকার যেদিন বিদেশিদের কাছে ভিক্ষা চাওয়া বন্ধ করবে, আমিও সেই দিন ভিক্ষা করা বন্ধ করে দেব।’
জাভেদ হুসেন সম্পাদকীয় সহকারী, প্রথম আলো
তথ্যসূত্র: ডন, জংগ, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, সাউথ এশিয়া জার্নাল, দ্য ইকোনমিক টাইমস