বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ডায়রিয়া রোগের বিস্তার ঘটে বনের আগুনের মতো। ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনায় পৃথিবীর ‘রোল মডেল’ বাংলাদেশের গাছের পাতাও জানে সে কথা। তারপরও এমন বেতাল অবস্থা! ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুরে ডায়রিয়া সামাল দেওয়া ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে ডায়রিয়ায় শিশুমৃত্যুর খবর আসতে শুরু করেছে।
ফেনীতে ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের আঙিনায় খোলা আকাশের নিচে রোগীরা পাটি, চাটাই, চাদর বিছিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একটি শামিয়ানার ব্যবস্থা কেউ করতে পারেননি। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শয্যা ১৮টি, কিন্তু রোগী ১৪০ জন। কী আর করা?
কোথাও গাছের সঙ্গে বাঁধা দড়িতে ঝোলানো হয়েছে স্যালাইন। এক জায়গায় আট–নয় বছরের একটি মেয়েশিশু উঁচু করে ধরে রেখেছে স্যালাইন ব্যাগটি। মাটিতে মায়ের কোলে তার এক বছরের ভাইয়ের হাতে লাগানো আছে সেই স্যালাইনের সুই। বোনটি বারবার হাতবদল করেও উঁচু করে রাখছে ব্যাগটি। সকাল থেকে সে–ও কিছু খায়নি। কতক্ষণ পারবে সে স্যালাইনের ব্যাগটি ধরে রাখতে?
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর স্রোত বাড়তে থাকে। মূলত গত ২৫ আগস্ট থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগী আসা শুরু হয়েছে। তবে গত দুই দিনে তা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সেদিন দুপুর ১২টা নাগাদ রোগীর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়। এটা ২ সেপ্টেম্বরের কথা।
রোগীদের অভিযোগ, ওষুধ দিচ্ছে না হাসপাতাল থেকে। তত্ত্বাবধায়ক স্বীকার করলেন ওষুধের সংকটের কথা। হাসপাতালটি বন্যায় ডুবে গিয়ে বেশ কিছু ওষুধ নষ্ট হয়েছে। এ কারণে রোগীদের কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। তবে তিনি আশাবাদী। জানালেন ‘প্রয়োজনীয় ওষুধের জন্য চাহিদা দিয়েছি। ওষুধ চলে আসবে।’
নোয়াখালী সদর হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীতে সয়লাব, বেশির ভাগই শিশু। খালি চোখের হিসাবে ৯৫ শতাংশই শিশু। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অস্থায়ী ওয়ার্ড খোলা হয়েছে পাশের একটি নির্মাণাধীন ভবনে। সেখানে কোনো শয্যা নেই। টয়লেট–সুবিধা নেই। মেঝেতে শয্যা পেতে চলছে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা। কোনো কোনো শয্যায় একসঙ্গে দুজন রোগীকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। থাকতে থাকতেই মিনিট পঁয়ত্রিশের মধ্যে সাত থেকে আটজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু নিয়ে অভিভাবকেরা এলেন। পথের সব রিকশা মনে হলো হাসপাতালের দিকেই যাচ্ছে।
নোয়াখালীর এই হাসপাতালে ১৬ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীকে রেখে চিকিৎসা করা যায়, কিন্তু এখন (রোববার ১ সেপ্টেম্বর) সেখানে ভর্তি ৬১০ জন রোগী। জানা গেল, রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৫১ জন। রোগীদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসা নিতে আসা সবাইকে ঢালাওভাবে ভর্তি করা না গেলেও প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। রোগীর চাপে নার্স ও আয়ারা বিপর্যস্ত।
ফেনীর মতো সেখানেও ওষুধের সংকট। একজন মা জানালেন, হাসপাতাল থেকে তাঁকে স্যালাইনও দেয়নি। সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনে এনেছেন। হাসপাতালের নোংরা পরিবেশ নিয়েও তিনি বললেন অনেক কথা। চিকিৎসকেরা জানালেন, শুধু ডায়রিয়া নয়, বন্যার কারণে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে পেটব্যথাসহ শিশুদের নানা ধরনের রোগ হচ্ছে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের স্যালাইনের পাশাপাশি জিংক দেওয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে মনে হলো কথাটা তাঁরা শুনতে পাননি।
হাসপাতালগুলো পানিতে ডুবে যাওয়ায় ওষুধের ব্যবহারোপযোগিতা নষ্ট হয়েছে, সংকটের এটি একটি কারণ। নষ্ট ওষুধ নষ্ট করার একটি সরকারি প্রক্রিয়া আছে। ঢাকা থেকে নতুন ওষুধ প্রেরণের একটি নিয়মনীতি আছে। এগুলো কাটছাঁট না করলে সরবরাহ লাইনের জ্যাম কাটবে না। পরামর্শমতো, যাঁদের সাধ্য আছে, তাঁরা ওষুধ বাইরে থেকে কিনছেন। হাসপাতাল ডোবার সময় ফেনীর মাইজদীর ওষুধের দোকানগুলোও ডুবে ছিল। সেই সব ফার্মেসি এখন ওষুধ বিক্রি করছে। ড্রাগ অ্যাডমিনেস্ট্রেশন এদিকে একটু মন দিলে ভালো হয়।
নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর চাপ অনেক বেশি। হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সের সংকট রয়েছে। এরপরও সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়া হচ্ছে। ফেনী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক একই কথা বলেছেন, ‘তিন মাস ধরে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কেউ নেই। এ ছাড়া মেডিকেল অফিসারও পর্যাপ্ত নয়। নার্সের সংকট আছে।’ ডায়রিয়া ব্যবস্থাপনার জন্য খুব বড় চিকিৎসক লাগে না। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রাথমিক চাপ সামলানোর জন্য যথেষ্ট। সারা দেশ থেকে স্বাস্থ্যকর্মী, মেডিকেল কলেজগুলোর সিনিয়র শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে কাজে লাগানো যায়।
আক্রান্ত রোগীর রোগের ধরন, কলেরা জীবাণু আছে কি না, আমাশয় হলে তার প্রকৃতি কী, রোগের উৎস কী, স্যালাইনের সঙ্গে জিংক দেওয়া হচ্ছে কি না, তার মাত্রা সবাই জানে কি না—এসব প্রশ্নের উত্তর না থাকলে পরিস্থিতি মোকাবিলার কৌশল ঠিক করা যাবে না। ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞদের দল যাচ্ছে, তবে মাঠে যাঁরা পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে প্রতি দুই দিনে একবার তঁাদের মোলাকাত হওয়া দরকার।
নিরাপদ পানি আর নিরাপদ পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে না পারলে ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। এটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরও জটিল হয়েছে ত্রাণসামগ্রীর সঙ্গে প্লাস্টিক আর পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে। ত্রাণকর্মীদের দেওয়া স্যানিটারি ন্যাপকিন আর ডায়াপার ব্যবহারের পর এখন পড়ে আছে যেখানে–সেখানে। শেষ পর্যন্ত সব বর্জ্যের ঠাঁই হবে পুকুর আর জলাশয়ে। পুকুরগুলো কমপক্ষে গোসলের উপযোগী করা খুবই জরুরি। এ জন্য প্রতি শতাংশের জন্য মাত্র এক কেজি চুনই যথেষ্ট।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে, তা ছাড়া চর্মরোগ ইত্যাদি থেকে মুক্ত রাখতে তাদের ভিটামিন সি প্রয়োজন হবে। পাকা তাল আর বাতাবিলেবু সে তাল সামলানোর জন্য যথেষ্ট। রিলিফ কোম্পানিগুলো ভেবে দেখতে পারে।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক nayeem5508@gmail.com