ইদানীং আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি দেখে মনে হয়, তাঁরা আর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন না। তাদের সব মনোযোগ বিএনপিকে ঘিরে।
যতই দিন যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যে আত্মঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন, সে বিষয়ে দলীয় নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথা নেই। এমনকি তাঁদের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ যে দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে টার্চার সেল খুলে নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, সেসব নিয়েও তারা খুব বিচলিত নন। মাঝেমধ্যে ছাত্রদল-শিবিরের অনুপ্রবেশকারীদের ওপর সব দায় চাপিয়ে ছাত্রলীগকে সাচ্চা সংগঠন হিসেবে প্রমান করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছেন।
সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারির) পত্রিকায় এসেছে, নরসিংদীর শিবপুরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এর কারণ কেবল রাজনৈতিক দলাদলি নয়, হাটবাজারের ইজারার ভাগ-বাঁটোয়ারা। যেখানে টাকার গন্ধ, সেখানেই আওয়ামী লীগে কোন্দল।
এ রাজনৈতিক ডামাডোলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণকের মতো ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘বিএনপির শেষ খবর কী। বিএনপি এখন খরার কবলে। অচিরেই হাসপাতালে যাবে। নির্বাচনে না গেলে আইসিইউতে যাবে।( প্রথম আলো, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)
আওয়ামী লীগের যেসব নেতা বিএনপিকে আইসিউতে দেখতে চান, তাঁরা নিজেরা কোথায় আছেন, একবার ভেবে দেখেছেন কি? বিএনপি ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে। আর আওয়ামী লীগ ১৪ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায় আছে। প্রতিবারই তারা রেকর্ড সংখ্যক আসনে জয়ী হয়ে গণতন্ত্র পাহারা দিচ্ছেন। এক সময় আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির আন্দোলনকে উপহাস করছেন। এখন মনে হয় সেই উপহাস তাদের দিকেই ফিরে আসছে।
ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের আরও নেতা–মন্ত্রী কয়দিন পরপর এভাবে বিএনপিকে আইসিইউতে পাঠাতে চান। আইসিইউ মানে হাসপাতালের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট। রোগীর অবস্থা শোচনীয় হলে আইসিইউতে নেওয়া হয়। কিন্তু ওবায়দুল কাদের সাহেব কীভাবে গণনা করে বললেন, বিএনপি প্রথমে হাসপাতালে যাবে এবং এরপর তাকে চিকিৎসার জন্য আইসিইউতে নেওয়া হবে। বিএনপি আইসিউতে গেলে আওয়ামী লীগের লাভ না ক্ষতি?
এত দিন আমরা দেখেছি, দলের নেতা-কর্মীরা অসুস্থ হলে হাসপাতালে যান। আবার সরকারের পুলিশ কিংবা সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনের শিকার হয়েও অনেককে হাসপাতালে যেতে হয়। কিন্তু একটি পুরো রাজনৈতিক দলকে কীভাবে হাসপাতালে নেবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক? তা-ও হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ড বা কেবিনে নয়, একেবারে আইসিইউতে। করোনাকালে আইসিইউর কথা শুনলে বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠত। আইসিইউতে যাওয়া মানে ফিরে আসা না আসার সুতায় জীবন ঝুলে থাকা।
আওয়ামী লীগের যেসব নেতা বিএনপিকে আইসিউতে দেখতে চান, তাঁরা নিজেরা কোথায় আছেন, একবার ভেবে দেখেছেন কি? বিএনপি ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে। আর আওয়ামী লীগ ১৪ বছর ধরে একটানা ক্ষমতায় আছে। প্রতিবারই তারা রেকর্ড সংখ্যক আসনে জয়ী হয়ে গণতন্ত্র পাহারা দিচ্ছেন। এক সময় আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির আন্দোলনকে উপহাস করছেন। এখন মনে হয় সেই উপহাস তাদের দিকেই ফিরে আসছে।
বিএনপি যখন বিভাগীয় শহরগুলোতে গণসমাবেশ করল, আওয়ামী লীগ নেতারা বললেন, ও কিচ্ছু না। তাঁদের সমাবেশে বিএনপির চেয়ে ১০ গুন বেশি লোক আসবে। লোক আসেনি। আনা হয়েছে। বিশেষ ট্রেন ভাড়া করে। লঞ্চ, স্টিমার, মাইক্রো, গাড়ি, বাস ভর্তি করে। আর বিএনপির সমাবেশের দিন পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের দিয়ে। দেশের মানুষকে এতটা বোকা ভাবা বোধ হয় ঠিক নয়। তাঁরা চালাকিটা ঠিকই ধরতে পারেন।
আওয়ামী লীগ নেতারা যে দলকে আইসিইউতে পাঠাতে চান, সে দলের সবচেয়ে নিরীহ কর্মসূচি পদযাত্রায় তাদের হাঁটু কাঁপা শুরু হলো কেন? কেন বিএনপির পদযাত্রার কর্মসূচির দিনই তাঁদের পাল্টা কর্মসূচি দিতে হয়। শান্তি-সমাবেশ করতে হয়। এর মাধ্যমে কি তাঁরাই সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করলেন না? ক্ষমতায় থাকলে সবই জায়েজ হয়ে যায়। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তারাও নানা রঙ্গ দেখিয়েছে। মনে আছে, বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচির দিন দলের দুই তরুণ নেতা রাস্তায় ক্রিকেট খেলার মহড়া দিয়েছিলেন। এসব হলো রাজনীতির নামে ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ। বিএনপির আমলে যদি মানুষ সেই দম্ভকে মেনে না নেয়, এখনো মানবে না। একদিন না একদিন ঠিকই প্রতিবাদ জানাবে।
ক্ষমতার দম্ভ নিয়ে আরেক দিন লেখা যাবে। আজ হাসপাতাল আইসিইউর মধ্যেই আলোচনা সীমিত রাখতে চাই। ওবায়দুল কাদের সাহেব বিএনপিকে আইসিইউতে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবেন। আমাদের বিভেদাত্মক রাজনীতির এটাই ধর্ম। প্রতিপক্ষের সর্বনাশের মধ্যেই তাঁরা নিজেদের বিজয় দেখতে চান। বিএনপি সত্যি সত্যি হাসপাতাল কিংবা আইসিইউতে যায় কি না, সেটি দেখার অপেক্ষায় আছে দেশবাসী।
কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যাঁরা ৫১ বছর ধরে দেশ শাসন করেছেন, তাঁরা যে গণতন্ত্রকেই আইসিইউতে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তার প্রতিকার কী? এই দলে আওয়ামী লীগ বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সবাই আছে। একে অপরের মন্দটা অনুসরণ করছে এবং ভালোটা যথটা সম্ভবব পরিহার করে চলছে।
পাঁচ বছর পর পর দেশে নির্বাচন হয়। নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরা বিপুল ভোটে জয়ী হন। কিন্তু গণতন্ত্রকে আইসিইউ থেকে কেবিনে নিয়ে আসতে পারছেন না কেউ। দেশের অর্থনীতি এখন গভীর সংকটে। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। ওএমএসের ট্রাকের সামনে লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সেসব নিয়ে রাজনীতিকদের চিন্তা নেই। তারা ব্যস্ত আছেন কে কাকে কতভাবে ঘায়েল করতে পারবেন, সেসব নিয়ে। আর গণতন্ত্র এখন আইসিইউতে।
একটি রাজনৈতিক দল আইসিইউতে গেলে হয়তো আরেকটি দল তার শূন্যতা পূরণ করতে পারে, কিন্তু রাজনীতিকেরা যখন সবাই মিলে গণতন্ত্রকেই আইসিইউতে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তখন তাকে উদ্ধার করার কেউ থাকে না। ওবায়দুল কাদের যেমনটি বলেছেন, নির্বাচনে না গেলে বিএনপি আইসিউতে যাবে। কিন্তু একটি সাজানো নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে আইসিউ থেকে উদ্ধার করতে পারবে, সেই ভরসা দেখি না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি