মতামত

গরুর মাংসের দাম যে উপায়ে কমানো যায়

আমাদের দেশে মাংস উৎপাদনের জন্য ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের খামার গড়ে উঠেছে
ছবি: প্রথম আলো

সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ প্রচেষ্টায় গত দুই দশকে বাংলাদেশে ও দুধ উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে আমরা মাংস উৎপাদনে ইতিমধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। দুধ উৎপাদনেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে। সরকার সার্বিক প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে, তথা মাংস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য খামারিদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করছে, যা এ দেশের জনগণের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস, ২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, ২০০১-০২ সালে মাংস উৎপাদন ছিল প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২১-২২ সালে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৯৩ লাখ মেট্রিক টন (প্রায় ১০ গুণ)। মোট মাংস উৎপাদনের একটি বড় অংশ (প্রায় ৪৯ দশমিক ৮১ শতাংশ) আসে গরু থেকে (ডিএলএস, ২০২৩)। যদিও গত ১০ বছরে গরুর সংখ্যা মাত্র ৬ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু মাংস উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৫৬ শতাংশ।

বর্তমানে বাৎসরিক মাথাপিছু মাংস গ্রহণ প্রায় ৫৫ কেজি, যা চাহিদার তুলনায় কিছুটা বেশি। আমাদের দেশে মাংস উৎপাদনের জন্য ছোট-বড় বিভিন্ন আকারের খামার গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফ) এবং ডিএলএসের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১২ লাখ খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ৯৪ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এসব খামারে বিভিন্ন আকারের এবং ওজনের গরু পালন করা হয়, যা সারা বছর, বিশেষ করে কোরবানির সময় বিক্রি করা হয়ে থাকে। মাঠপর্যায়ে তথ্য অনুযায়ী, এসব গরুর ওজন সাধারণত ২০০ কেজি (যার বাজারমূল্য প্রায় ১ লাখ টাকা) থেকে ৭০০-৮০০ কেজি (যার বাজারমূল্য প্রায় ৫ লাখ টাকা) বা তারও বেশি।

প্রাণিসম্পদ খাতের অন্যতম একটি অবদান হচ্ছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির প্রাণী সরবরাহের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। খুশির খবর হলো, এ বছর চাহিদার তুলনায় কোরবানির জন্য উপযোগী প্রাণীর উৎপাদন বেশি। যেমন এ বছর প্রাণীর চাহিদা হলো ১ দশমিক শূন্য ৪ কোটি, বর্তমানের সরবরাহের সংখ্যা ১ দশমিক ২৫ কোটি। এর মধ্যে গরুর সংখ্যা প্রায় ৪৮ দশমিক ৪ লক্ষ (ডিএলএস, ২০২৩)।

বিভিন্ন তথ্য থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের গরুর মাংসের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। যেমন বাংলাদেশে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ৬ দশমিক ৯৪ ডলার, মালয়েশিয়াতে ৫ দশমিক ৩৭ ডলার, নেপালে ৪ দশমিক ২৯ ডলার এবং পাকিস্তানে ৩ দশমিক ৬০ ডলার (সূত্র: বাংলাদেশ বিফ প্রাইজ, গ্লোবাল প্রোডাক্ট প্রাইজ ২০২৩, বিফ প্রাইজ, সিপিডি ২০২৩)।

কাজেই আমাদের দেশে মাংস উৎপাদনের খরচ কমানোর ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশে এখন শিক্ষিত যুবক ও নারীরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গরু পালন করছেন।

আমাদের দেশে বর্তমানে গরুর মাংসের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। সুতরাং আমাদের দেশে আবহাওয়া উপযোগী অধিক টেকসই গরুর ভালো একটি জাত প্রয়োজন (হাই বিফ জেনেটিকস), যার এফসিআর (খাদ্য রূপান্তর হার) হবে ৫ থেকে ৭, অর্থাৎ ৫ থেকে ৭ কেজি খাবার খেয়ে এক কেজি মাংস হবে।

মাংস উৎপাদনের জন্য বর্তমানে শাহীওয়াল ও ফ্রিজিয়ান সংকর জাতসহ আরসিসি ও দেশি জাতের গরু পালন করা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে মাংসের দাম আশপাশের দেশ থেকে কেন বেশি, এবং কীভাবে উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব?

আমরা জানি, উন্নত জাতের গরু দেশীয় জাতের গরুর তুলনায় কম খাদ্যে দ্রুত ওজনে বৃদ্ধি পায়। গরুর জাত বাছাইয়ের ওপর এর উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদন খরচ নির্ভর করে। মাংসের দাম কমাতে হলে এর উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:

১.

আমাদের দেশে বর্তমানে গরুর মাংসের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। সুতরাং আমাদের দেশে আবহাওয়া উপযোগী অধিক টেকসই গরুর ভালো একটি জাত প্রয়োজন (হাই বিফ জেনেটিকস), যার এফসিআর (খাদ্য রূপান্তর হার) হবে ৫ থেকে ৭, অর্থাৎ ৫ থেকে ৭ কেজি খাবার খেয়ে এক কেজি মাংস হবে।

এটি দ্রুত বর্ধনশীল হতে হবে এবং দুই থেকে আড়াই বছরে ওজন হবে ৫০০ থেকে ৭০০ কেজি। স্থানীয়ভাবে পালন করলে রোগবালাই কম হয়। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, দেশি গরুর এফসিআর প্রায় ১২, ক্রসব্রিড ৮ থেকে ১০ এবং ব্রাহমা ক্রস ৫ থেকে ৭।

উল্লেখ্য, এফসিআর যত কম হবে, উৎপাদন খরচ তত কমবে। ব্রাহমার দৈনিক ওজন বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে বেশি এবং দৈনিক বৃদ্ধি প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম।

২.

গত এক দশকে সরকার এ দেশে উন্নত ব্রাহমা গরু নিয়ে কাজ করেছে এবং এই গরু অধিক উৎপাদনশীল হওয়ায় ইতিমধ্যে খামারিদের মধ্যে ওই সব গরু পালনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।

ব্রাহমা জাত মাংস উৎপাদনের জন্য একটি স্বীকৃত জাত। ব্রাহমা মাংসের জন্য সেরা গরু, এর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ও তাপ সহনশীলতা বেশি। উল্লেখ্য, বর্তমান ব্রিডিং পলিসিতে ব্রাহমা জাত দ্বারা সংকরায়ণ করা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কারণ, এই জাতের গরুর মাঠপর্যায়ে অনিয়ন্ত্রিতভাবে সম্প্রসারণ ঘটলে দুধ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
তবে মাঠপর্যায়ে খামারিদের সঙ্গে আলোচনায় এসেছে, আমাদের দেশে উৎপাদনের জন্য ব্রাহমা গরু পালনের প্রয়োজন আছে এবং এ গরু পালন করলে খামারিরা বেশি উপকৃত হবে।

তবে এ ক্ষেত্রে যত্রতত্র ব্রিডিং করা যাবে না, শুধু যে সব বাণিজ্যিক খামারে মাংস উৎপাদনের জন্য নিয়ন্ত্রিতভাবে গরু পালন করা হবে, সেই সব খামারে ব্রাহমা সংকর জাত পালন করতে হবে।

এতে একদিকে মাংসের উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে মাংস উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কম হবে। এ ক্ষেত্রে খামারিদের আরও সচেতন করতে হবে।

৩.

গরু পালনের ক্ষেত্রে গুণগত খাদ্য সরবরাহরে ওপর নির্ভর করবে তার মাংসের উৎপাদন। উৎপাদনের বড় খরচ হচ্ছে খাদ্যের খরচ (প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ)। কাজেই আমাদের উচ্চ মূলের দানাদার খাবারের ওপর বেশি নির্ভরশীল না হয়ে উন্নত জাতের অধিক পুষ্টিসম্পন্ন ঘাস চাষের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং সাইলেজ ব্যবহারের জন্য গুরুত্বারোপ করতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ কম হবে।
এ ছাড়া স্থানীয় উপাদান দিয়ে সুষম খাদ্য তৈরি করলেও খাদ্যে খরচ কম হবে। তা ছাড়া আমদানি করা খাদ্য উপকরণে কর মওকুফ বা কর ছাড়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৪.

ক্লাইমেট স্মার্ট লাইভস্টক পালন পদ্ধতির একটি প্রধান উপাদান হলো গরুর সংখ্যা বৃদ্ধি না করে এর উৎপাদনশীলতা বাড়ানো। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা সফলতা লাভ করেছি এবং আরও সুযোগ আছে। মাংস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আমাদের আরও অধিক উৎপাদনশীল গরু পালনের জন্য খামারিদের উৎসাহিত করতে হবে।
বর্তমানে কৃত্রিম প্রজননের আওতায় প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ প্রজনন উপযোগী গরু প্রজনন করা হচ্ছে এবং এই কার্যক্রম আরও সম্প্রসারণের মাধ্যমে অধিক সংকর জাত তৈরি করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।

৫.

আমাদের দেশের খামারিরা গরু পালনকে লাভজনক ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এখন আমাদের প্রয়োজন ফার্মের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য খামারিদের প্রশিক্ষণ প্রদানপূর্বক উপযুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার, মেকানাইজেশনসহ ফার্মিং টেকনিক উন্নত করা এবং ভালো ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া পর্যাপ্ত গবেষণা ফোকাস করতে হবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হলে প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে। কাজেই এখন থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন, তথা মাংস উৎপাদনের জন্য অধিক মাংস উৎপাদনশীল গরু পালনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজ করলে এই সেক্টরে প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব।

৬.

প্রাণিস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রোগ প্রতিরোধ ও রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা ও সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে অধিক উৎপাদন পাওয়া সম্ভব হবে। বিশেষ করে বাছুরের মৃত্যুহার কমানোর লক্ষ্যে এর সঠিক ব্যবস্থাপনা দরকার। বাছুর জন্মের পর পর্যাপ্ত দুধ খাওয়ানো। কৃমিনাশক খাওয়ানো এবং উপযুক্ত সহযোগী খাবার প্রদান করতে হবে।

৭.

মাংস বাজারজাতকরণে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এ জন্য কোল্ডস্টোরেজ সুবিধাসহ আধুনিক জবাইখানা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পশু পরিবহনব্যয় কমানোর লক্ষ্যে পথের অনাকাঙ্ক্ষিত বাধা দূর করতে হবে, মধ্যস্বত্বভোগীর সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে এবং তাদের কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে। ইচ্ছাকৃত দাম বাড়া রোধে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হলে প্রাণিজ প্রোটিনের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে। কাজেই এখন থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রাণিসম্পদের উন্নয়ন, তথা মাংস উৎপাদনের জন্য অধিক মাংস উৎপাদনশীল গরু পালনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজ করলে এই সেক্টরে প্রত্যাশিত উন্নয়ন সম্ভব।

  • ড. এফ এইচ আনসারী প্রেসিডেন্ট, অ্যাগ্রিবিজনেস, এসিআই লিমিটেড