জনগণের রাষ্ট্র নির্মাণের কারিগরদের অন্যতম কাজ হলো ব্যয় সাশ্রয় করা। সর্বনিম্ন জোগান দিয়ে সর্বোচ্চ ফল নিয়ে আসা। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পর রাশিয়া ১৯২০ সাল নাগাদ ১২ থেকে ১৪টি দেশের একযোগে হামলা ঠেকিয়ে ১৯৩০ সালের মহামন্দায় পৃথিবীর দ্বিতীয় সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হলো। কেমন করে? কারণ, রুশ নেতৃত্ব জনগণকে সেই উপলব্ধি দিতে পেরেছিলেন, রাশিয়ার উন্নতি মানে তাদের উন্নতি। দেশের সম্পদের ওপর দাঁড়িয়েই তাঁরা এই অসাধ্যসাধন করেছেন।
এমন অসাধ্য সাধনের জন্য চাই জনগণের মালিকানাবোধ। এমন মালিকানাবোধ থাকলেই আমাদের তরুণেরা বলতেন পারেন, ‘বুক পেতেছি গুলি কর’। কিন্তু সেই মালিকাবোধ পোক্ত হবে কখন? যখন দেখবেন রাষ্ট্রের নেতারা চিলমারী থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত জনগণের কাছে যাচ্ছেন।
আর্কিমিডিস যখন কপিকল পদ্ধতি আবিষ্কার করে বলেছিলেন, কপিকলটা বসানোর জায়গা দাও, পৃথিবীটা নাড়িয়ে দেব। আমরাও যা করব, তা এ দেশের বিদ্যমান অবকাঠামোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করেই করতে হবে সাশ্রয়ী সংস্কৃতি গড়ে তুলে। এ দেশের সৃজনশীল মানুষ পানির পাম্পকে নৌকায় জুড়ে দিয়ে নৌযোগাযোগে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। নদী খনন করতে হবে? খননের জন্য বাজেট দেওয়ার দরকার নেই। জনগণকে নদীর সীমানা দেখিয়ে মাটি তুলে নিতে বলেন, দেখবেন ১০ ফুটের জায়গায় ১২ ফুট গভীর করে বিনা টাকায় নদী খনন হয়ে গেছে।
একদিকে সংস্কৃতিকর্মীদের মহড়ার জায়গা নেই, প্রদর্শনের মঞ্চ নেই। পড়াশোনার পাঠাগার নেই, আলোচনার জন্য নেই ফ্রি সেমিনার হল। অন্যদিকে জায়গা, ভবন ও মঞ্চ বেশুমার পতিত হয়ে আছে। অব্যবহৃত জেলা ও উপজেলা সদরের টাউন হলগুলো, পৌর মার্কেট, উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও ইউনিয়ন পরিষদ ভবনগুলো। নদী, পুকুর, পার্ক ও হাট উৎসবহীন।
শিল্পীরা না খেয়ে মরেন, যাপন করেন অসম্মানিত জীবন। বই পড়ার সুযোগ নেই। শিল্পীদের পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। চিত্রশিল্পীদের ছবি প্রদর্শনের গ্যালারি নেই, সিনেমা দেখার সুযোগ নেই। ব্যক্তিমালিকানার হলগুলো বন্ধ হওয়ায় সিনেমা দেখাও প্রায় বন্ধ।
তাহলে? মুক্তিযুদ্ধের আর গণ–অভ্যুত্থানের বাংলাদেশ জনগণের হয়ে গড়ে উঠবে না?
টাউন হলগুলোর ডিজাইন দেখলেই বোঝা যায়, হাসিনা সরকার টাউন হল চিনত না, কমিউনিটি সেন্টার চেনে। প্রত্যেক স্বৈরাচারের মতো তারাও চায়নি সংস্কৃতিচর্চার বিকাশ। এগুলোর টাইলস উঠিয়ে কিছু ইট ধাপে ধাপে বসালেই সত্যিকারের টাউন হলে পরিণত হবে। টাইলস বসানোর সংস্কৃতি থেকে বের হলে লাখখানেক টাকাতেই এটি সম্ভব। সে টাকাও স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দেবেন, যদি কোথাও দাতা হিসেবে তাঁর নাম থাকে।
টাউন হল এলাকা সংস্কৃতিকর্মীদের এলাকা বলে চিহ্নিত করতে হবে। চত্বরের জমিতে ঘর তুলে সাংস্কৃতিক সংগঠনের জন্য বরাদ্দ করলেই সংগঠন গড়ে তোলার জোয়ার উঠবে। ঘর তুলে দেবেন স্থানীয় ধনাঢ্যরা। শ্বেতপাথরের ফলকে শত বছর ধরে দাতাদের নাম-পরিচয় জ্বলজ্বল করবে। এখনো কারমাইকেল কলেজে ১৯০৮ সালের দাতাদের নাম আমরা পড়তে পাই। ইউএনওরা ডাক দিলে তাঁরা এগিয়ে আসবেন।
প্রতিটি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স আছে। প্রতিটিই তিনতলা। যাঁদের ভাড়া দেওয়া হয়েছে, তাঁরা ক্ষমতার জোরে নিয়েছেন। দীর্ঘদিন ভাড়া দেন না। লোকজনের আসা-যাওয়া না থাকায় মার্কেটও জমেনি। তৃতীয় তলায় বড় একটা সেমিনার রুম আছে, সেটিও কখনো ব্যবহৃত হয় না। আর নিচের তলা দুটি ১০০ বর্গফুটের অনেকগুলো দোকান।
নিচতলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য বরাদ্দ রেখে দ্বিতীয় তলা পাবলিক লাইব্রেরিতে পরিণত করা যায়। এই লাইব্রেরি পরিচালিত হবে জেলা পাবলিক লাইব্রেরির তত্ত্বাবধানে। আর তৃতীয় তলার সেমিনার রুমটি বিভিন্ন পাঠচক্র গ্রুপসহ সবার জন্য ফ্রিতে ব্যবহারের সুযোগ রাখতে হবে। আর ছাদে চা-শিঙাড়ার দোকান হবে, যেটি পরিচালনা করবে একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবার।
জেলা শহর বা পৌরসভাগুলোয় সবকিছু আছে, কিন্তু বইয়ের দোকান বা বুক ক্যাফে নেই। বইয়ের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হওয়ার সুযোগ নেই। তাই শাহবাগের আজিজ সুপারমার্কেট বই থেকে কাপড়ের মার্কেটে পরিণত হয়। ব্যক্তিগত বিপণিবিতানগুলো বইয়ের জন্য ভাড়া পাওয়াও মুশকিল। ফলে সব কটি বিভাগীয় শহরেও বড় বইয়ের দোকান নেই।
পৌরসভার মার্কেটের ৫০০ গজের মধ্যে স্কুল-কলেজ থাকলে সেখানে বইয়ের দোকান ও সিনেপ্লেক্সের জন্য দুটি মার্কেটে বরাদ্দ রাখতে হবে। দুই হাজার বর্গফুট জায়গা অর্ধেক ভাড়ায় বরাদ্দ দেওয়া বাধ্যতামূলক হবে।
ইউনিয়ন পরিষদগুলোয় হলরুম ও বড়সড় চত্বর আছে। সেগুলোকেও ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে। এটাকে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ও পাঠাগারের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়া যায়। এ ছাড়া নদ–নদী, পুকুর, খাল, বটতলা ও হাটগুলোয় নামমাত্র খরচে খোলামঞ্চ স্থানীয় কৃতী ব্যক্তিদের নামে করা যায় বা যাঁরা মঞ্চ নির্মাণে খরচ বহন করবেন, তাঁদের দাতা হিসেবে নাম উল্লেখ থাকবে সেখানে।
শিল্পকলা একাডেমি যেন টাউন হলের আশপাশে থাকে, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি।
শিল্পকলা একাডেমিতে প্রশিক্ষকই নেই। আর্ট গ্যালারি থাকবে কী করে আর নতুন শিল্পী জন্ম নেবে কেমন করে? একদিকে শেখার সুযোগ নেই, অন্যদিকে শিল্পীর দীন, অনাকর্ষণীয় জীবন। যে সমাজে গুণীর কদর নেই, সে সমাজে গুণী জন্মায় না।
প্রতিটি উপজেলায় ২০ জন শিল্পীকে আজীবন জনপ্রতি মাসিক পাঁচ হাজার টাকা ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা প্রয়োজন। এটা একদিকে রাষ্ট্রীয় সম্মান, অন্যদিকে আর্থিক নিশ্চয়তাও। এতে স্থানীয় ঘরানা, যেমন ভাওয়াইয়া, জারি ও বাউলশিল্পীদের প্রাধান্য দিতে হবে। তাঁরা গানও শেখাবেন। এ ছাড়া চিত্রশিল্পী, আবৃত্তিকার, নৃত্যশিল্পী ও লেখকেরাও এতে অন্তর্ভুক্ত হবেন। উপজেলাপ্রতি মাসিক খরচ পড়বে এক লাখ টাকা। এই টাকার জোগান আসবে বিভিন্ন ইজারা থেকে। অথবা রাষ্ট্র দায়িত্ব নিলে সারা দেশে মোট লাগবে মাসিক ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বছরে ৭০ কোটি প্রায়। এই পরিমান কি খুব বেশি?
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী উপদেষ্টা বা একজন সচিব পদমর্যাদার স্বাপ্নিক ব্যক্তি প্রথম দুই মাসে সব ডিসি, ইউএনও ও স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সামনে এই ধারণা উপস্থাপন করবেন। পরের দুই মাসে অবকাঠামোগত পরিবর্তনটি হয়েছে কি না, সেটা নিজে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন। আগামী চার মাসেই সংস্কৃতি জগৎ দাঁড়িয়ে যাবে।
প্রথম পরিদর্শনের পর্বেই উপস্থিত সবার গোপন ভোটে জেলা শিল্পকলা একাডেমির কমিটি পাস করে দিয়ে আসবেন। তাৎক্ষণিক ভোটেই কমিটি গঠিত হবে।
জনগণের কাছে যাবেন, জনগণকে জাগাবেন—সব মন্ত্রণালয়ে এমন একজন করে দরকার। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় দিয়েই তা শুরু হতে পারে—এমন গণচরিত্রের একজনকে দিয়েই।
নাহিদ হাসান লেখক, সংগঠক ও ট্রাস্টি, বাংলাদেশ শিল্পীকল্যাণ ট্রাস্ট, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
nahidknowledge1@gmail.com