মতামত

আমাদের সম্রাট নিরোদের বিদেশে আনন্দভ্রমণ

‘রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ৪০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ২৬ জন একসঙ্গে ভারত সফরে। নিয়মে থাকলেও এই ভ্রমণের জন্য কাউন্সিলররা সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অনুমতি নেননি।’
‘রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ৪০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ২৬ জন একসঙ্গে ভারত সফরে। নিয়মে থাকলেও এই ভ্রমণের জন্য কাউন্সিলররা সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অনুমতি নেননি।’

রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন—এই প্রবাদের কথা কে না জানে। ৬৪ খ্রিষ্টাব্দে রোমে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ড ঘটে, ইতিহাসে যা ‘দ্য গ্রেট ফায়ার অব রোম’ হিসেবে পরিচিত। আর নিরো ছিলেন তখন রোমের সম্রাট। অগ্নিকাণ্ডের সময় তিনি ছিলেন ছুটিতে। রোমের বাইরে। সেই অগ্নিকাণ্ডে ৫ থেকে ১০ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়।

সম্রাট নিরো ছিলেন সংগীতপ্রেমী। নিজেকে গায়ক হিসেবে ভাবতেও পছন্দ করতেন। মূল ইংরেজি প্রবাদে যদিও বেহালা বাজানোর কথা আছে, বাংলা ভাষায় সেই প্রবাদে বেহালার জায়গা নিয়েছে বাঁশি।

নিরোর মতো আমাদের আছে এমন সম্রাট। একজন নন, অসংখ্য। তাঁরা কতটা সংগীতপ্রেমী, তা নিশ্চিত না হলেও তাঁরা যে বিদেশ ভ্রমণপ্রেমী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ৫ অক্টোবর ১০ বছরের মধ্যে এক দিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতে ডুবে যায় রাজশাহী। দেশের সবচেয়ে সুন্দর শহরের তকমা কুড়ানো রাজশাহীর বুকেও কফের মতো জমাট বেঁধেছিল অপ–উন্নয়ন মানে অপরিকল্পিত নগরায়ণ।

এক দিনের বৃষ্টিতেই সেই কফ উগরে পড়ে। আর এমন পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনটির ৪০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ২৬ জন একসঙ্গে ভারত সফরে। নিয়মে থাকলেও এই ভ্রমণের জন্য কাউন্সিলররা সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অনুমতি নেননি। ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ও জনদুর্ভোগে যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন আমাদের সম্রাট নিরোরা আমোদভ্রমণে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, নির্বাচিত নতুন মেয়র দায়িত্ব নেননি বলে সিটি করপোরেশনের সার্বিক কার্যক্রমের দায়িত্বে আছেন একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনিও জানেন না এ সফরের বিষয়ে। সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনে জয়ী মেয়র ও কাউন্সিলররা এখনো দায়িত্ব নেননি। ১১ অক্টোবর তাঁদের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।

ভারত ভ্রমণে যাওয়া ২৬ কাউন্সিলরের মধ্যে ৭ জন যদিও সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে হেরে যান। নিয়ম অনুযায়ী, অনুমোদন ছাড়া কোনোভাবেই ব্যক্তিগত বা দাপ্তরিক বিদেশ সফরে যাওয়ার সুযোগ নেই তাঁদের।

কী করে এতজন জনপ্রতিনিধি একসঙ্গে বিদেশে ‘আনন্দভ্রমণে’ গেলেন! এটি তখনই সম্ভব, যখন জনগণের কাছে জনপ্রতিনিধিরা কোনো দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না, আবার নিজ প্রতিষ্ঠান, কর্তৃপক্ষ বা মন্ত্রণালয়ের কাছেও জবাবদিহি করতে হয় না। ‘সুপ্রতিষ্ঠিত’ হয়ে যাওয়া এই ‘কালচারেই’ তো চলছে আমাদের জনপ্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা। এখানে জনগণ পানিতে ডুবল নাকি আগুনে পুড়ল, তা দেখার কী ঠেকা পড়েছে তাঁদের!

এরপরও কী করে এতজন জনপ্রতিনিধি একসঙ্গে বিদেশে ‘আনন্দভ্রমণে’ গেলেন! এটি তখনই সম্ভব, যখন জনগণের কাছে জনপ্রতিনিধিরা কোনো দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না, আবার নিজ প্রতিষ্ঠান, কর্তৃপক্ষ বা মন্ত্রণালয়ের কাছেও জবাবদিহি করতে হয় না। ‘সুপ্রতিষ্ঠিত’ হয়ে যাওয়া এই ‘কালচারেই’ তো চলছে আমাদের জনপ্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা। এখানে জনগণ পানিতে ডুবল নাকি আগুনে পুড়ল, তা দেখার কী ঠেকা পড়েছে তাঁদের!

পাহাড়-নদী-সমুদ্রের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নগরী চট্টগ্রাম কীভাবে জলাবদ্ধতার জন্যও ‘অনন্য’ হয়ে উঠেছে, তা কারও অজানা নয়। এ শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব দেওয়া হয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ)। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া হাতে নেওয়া হয় ‘চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন’ নামে একটি প্রকল্প।

আর প্রকল্প মানেই যে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর এ দেশে ‘আভিধানিক সত্য’। ফলে সেই প্রকল্পের পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক ঘুরে আসেন ব্রাজিল, পানামা ও চীন থেকে। অন্যদিকে তড়িঘড়ি করে নেওয়া সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটির এখন ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা।

কর্মকর্তারা অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য পানামা ও চীন ঘুরে এলেও সামান্য বৃষ্টিতে নগরবাসী পা নামাতে পারেন না সড়কে। সেগুলো তখন চীনের দুঃখের মতো একেকটা হোয়াং হো নদী হয়ে ওঠে। দুই দফায় প্রকল্পের সময় বেড়েছে তিন বছর। আরও এক বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

সিডিএর প্রকল্প মানেই বিদেশে ‘আনন্দভ্রমণ’—৩ অক্টোবর সমকাল পত্রিকার এ প্রতিবেদন থেকে আমরা এসব জানতে পারছি। প্রতিবেদনটি আরও বলছে, প্রতিষ্ঠানটির নানা প্রকল্পে ৩৪ জন কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণে গেছেন, যেখানে ২৩ জনই প্রকল্পের কেউ নন। নগর দেখভালের প্রতিষ্ঠানটি যেন সরকারি টাকায় বিদেশভ্রমণের ট্রাভেল এজেন্সি খুলে বসেছে!

২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে অচল হয়ে গিয়েছিল রাজধানী শহর। সে রাতে যাঁরা রাস্তায় ছিলেন, তাঁদের অনেকে এখন বৃষ্টি দেখলে আতঙ্কে ভোগেন, এমনটি বললে অমূলক হবে না। সেদিন জলাবদ্ধ রাস্তায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান একই পরিবারের তিনজনসহ চারজন। যার মধ্যে এক শিশুও ছিল, বেঁচে যায় আরেক শিশু। সড়কের পাশে পানির মধ্যে পড়ে ছিল তাঁদের নিথর দেহ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিও কি কখনো ভোলা সম্ভব? সেই দুর্যোগে কোনো মেয়র বা কাউন্সিলরকে নগরবাসী পাশে পাননি। নগর ডুবে গিয়েছিল আর আমাদের সম্রাট নিরোরা তখন ঘুমিয়েছিলেন। এতিম হয়ে যাওয়া শিশুটির কাছে যাওয়ারও ফুরসত মেলেনি তাঁদের।

এ মুহূর্তে ঢাকায় রীতিমতো মহামারি রূপ নেওয়া ডেঙ্গুতে কীভাবে একের পর এক মানুষ মরছে, শিশু মরছে, তছনছ হয়ে যাচ্ছে একেকটি পরিবার—তা সবারই জানা।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, গত জুলাই থেকে ঢাকায় যখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠছে, মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে; তখন এক মেয়র ১৭ দিনের জন্য ইউরোপের কয়েকটি দেশে পারিবারিক ও ব্যক্তিগতে সফরে যান। নগরবাসীর এমন বিপদের দিনে মেয়রের সপরিবার এই বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়।

আরেক মেয়র তো এ বছরের শুরুতে মশা নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য গেলেন। সেখানে গিয়ে হাতে–কলমে শিখে বুঝতে পারলেন, মশকনিধনে এত দিন পুরোনো ও ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছেন তাঁরা।

দেশে ফিরে সেই অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে ঢাকাকে মশামুক্ত করে ফেলা হবে বলে কী কী সব কথার ফুলঝুরি! দিন শেষে আমরা দেখলাম, সেই ভুল পদ্ধতি দিয়েই চলছে মশকনিধন। আর ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুতে আমাদের দেখতে হলো স্মরণকালের রেকর্ড।

এভাবেই চলে আমাদের সম্রাট নিরোদের বিদেশ সফর। আর নগরবাসী হিসেবে আমাদের নরকযন্ত্রণা।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com