ইন্টারনেট–প্রযুক্তি বা ডিজিটাল লিটারেসি নিয়ে শহর ও গ্রামের মধ্যে যে বৈষম্য বিদ্যমান, সেটি মোটামুটি জানা কথাই। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক যে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠছে, সেখানেও শহর, বিশেষ করে ঢাকা শহর আর ঢাকার বাইরের মধ্যকার বৈষম্য দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।
দেশে অ্যাসোসিয়েশন নিবন্ধিত সফটওয়্যার ফার্মের সংখ্যা দুই হাজারের ওপরে। কিন্তু আমরা কখনো জানতে চাই না, এর কত শতাংশ ঢাকার বাইরে? দেশের ভেতরেই সফটওয়্যার খাতে যে শতসহস্র কোটি টাকার কাজ হয়, তার কত শতাংশ ঢাকা শহরের বাইরে যায়? আমাদের সবকিছু রাজধানী শহরে। এর বাইরে আমরা যেন চিন্তাই করতে পারি না।
আমাদের পরিসংখ্যান, আমাদের উন্নতি বা অবনতি—সবকিছুর মাপকাঠি শুধু এই ঢাকা শহর। আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের সভা-সেমিনার, কল্পনা-পরিকল্পনা—সব যদি এই ঢাকা শহরেই কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়, তাহলে মিছে কেন আর এই গোটা দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা!
সংশ্লিষ্ট মেলাগুলো পর্যন্ত ঢুকে গেছে ঢাকা শহরের পাঁচ তারকা হোটেল কিংবা কনভেনশন সেন্টারে। অথচ এই মেলাগুলোকে কেন্দ্র করে হলেও আরেকটা শহর, আরেকটা ভেন্যুকে সবার কাছে তুলে ধরা যেত।
সারা দেশে তথ্যপ্রযুক্তি ও উচ্চ প্রযুক্তির টেকসই উন্নয়ন, অবকাঠামো–সুবিধা ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। এর আওতায় সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হচ্ছে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, ট্রেনিং ও ইনকিউবেশন সেন্টার। কিন্তু নানান কারণে এগুলো আশানুরূপ সফলতার মুখ দেখেছে খুব সামান্যই। অতীতের অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়।
২০১৫ সালে ১ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য পরবর্তী ৩ বছরকে লক্ষ্য ধরা হলেও পরবর্তী ৫ বছরে সাকল্যে ৭ হাজার ৫০০ জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। একমাত্র ঢাকার পার্কটি ছাড়া ঢাকার বাইরের বাকি একটি পার্কও ঘোষণার পাঁচ বছর পরও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। আগ্রহী উদ্যোক্তার অভাবে ভাড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি ৬০ শতাংশ জায়গা। (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ৮ নভেম্বর ২০২০)
ঢাকার বাইরে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতিগত সুবিধা না দিলে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান কখনো ঢাকার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে পারবে না। বিভিন্নভাবে ঢাকার বাইরের এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। যেমন মন্ত্রণালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি–সংশ্লিষ্ট কাজের ২০ শতাংশ ঢাকার বাইরের প্রতিষ্ঠান দিয়ে করানো যেতে পারে, বিশেষ ছাড় দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে, ঢাকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অংশীদার হিসেবে বাইরের প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করার বাধ্যবাধকতা দেওয়া যেতে পারে, ২০ শতাংশ লোকবল ঢাকার বাইরে থেকে নেওয়ার শর্ত দেওয়া যেতে পারে।
সপ্তাহ দুয়েক আগে দেশের এক বিভাগীয় শহরের এক সফটওয়্যার ফার্মে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে দেখা গেল, ইউএসএ থেকে দেওয়া নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর অনলাইনে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আছে। আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আছে উল্লেখযোগ্য হারে। তাঁদের আয়ের মূল উৎস আউটসোর্সিং; বিপিও বা সেবা খাতের বাইরের কাজগুলো করে থাকেন। ঢাকার তুলনায় অনেক কম বেতনে লোকবলও পেয়ে যান।
পে–স্কেল ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের মাসিক গড় বেতন ৩৮ হাজার টাকার কাছাকাছি। ঢাকার বাইরের বিভাগীয় শহরগুলোতে জীবনযাপনের খরচ কিছুটা হলেও কম বলে সেখানে গড় বেতনের কমেই লোকবল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু ঢাকার বাইরের এই প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বা সরকারের বড় ধরনের প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ পান খুব কম। অর্থাৎ কোনো কারণে আউটসোর্সিংয়ের কাজ না পেলে ওনাদের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে।
এই অনিশ্চয়তার মধ্যে কাজ করা চ্যালেঞ্জিং। যদিও নিকটবর্তী হাইটেক পার্ক ভবিষ্যতের ব্যাপারে ওনাদের আশাবাদী করে তুলেছে, বর্তমান অনেক প্রতিষ্ঠান হাইটেক পার্ককে কেন্দ্র করে ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখছে।
একই সময়ে আরেকটি শহরে গিয়ে কিছুটা জেলা শহরের অবস্থা আঁচ করা গেল। সেখানকার আইটি ফার্মগুলোতে খুব বেশি আশাজাগানিয়া চিত্র নেই।
সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মাঝেমধ্যে প্রশিক্ষণ বা ছোটখাটো মেলার আয়োজন করে। কিন্তু তাতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যক্ষ কোনো লাভ হয় না। অথচ ঐতিহ্যবাহী নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেখানে আছে, লোকবল পাওয়ার সম্ভাবনা সেখানেও কম নয়। তারও পরে গিয়েছিলাম একেবারে এক উপজেলা শহরে। সেখানে আইটি প্রতিষ্ঠান বলতে আইএসপি। অর্থাৎ শুধু ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে।
এই অল্প কয়েকটি জায়গায় গিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না, তবে এতটুকু পর্যবেক্ষণ দেওয়া যাবে যে প্রশাসনিকভাবে যে অঞ্চল বা যে শহর যতটুকু ওপরে বা নিচে অবস্থান করছে, সেখানকার তথ্যপ্রযুক্তি পরিস্থিতিও ততটুকু ওপরে বা নিচে অবস্থান করছে।
অন্য আর সব ব্যবসা বা উদ্যোগের ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণ স্বাভাবিক হলেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে সেটি বেমানান। তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে প্রশাসনিক কাঠামোর সম্পর্ক খুব বেশি থাকা উচিত নয়। অবকাঠামোগত দিক, মুঠোফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা, ঢাকার বাইরের হাইটেক পার্ক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়—সব মিলিয়ে এখনই আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে ঢাকার বাইরে বিকেন্দ্রীকরণ করার সময়।
তথ্যপ্রযুক্তির রাস্তা হলো ইন্টারনেট, কাঁচামাল হলো দক্ষ লোকবল। তথ্যপ্রযুক্তির রাস্তায় উঠে চালকের আসনে বসতে চাইলে ঢাকা শহরে আসার কোনো প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন থাকা উচিত নয়। এরপরও যদি ঢাকায় আসতে হয়, ঢাকায় এসে ব্যবসা করতে হয়, ঢাকায় এসে কাজ পেতে হয়, তাহলে এ রাস্তা থাকাটাই অর্থহীন। তথ্যপ্রযুক্তি মানেই ঢাকা শহর নয়, ঢাকা শহর মানেই বাংলাদেশ নয়।
● ড. বি এম মইনুল হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক
bmmainul@du.ac.bd