মতামত 

অধ্যাপক ইমতিয়াজ কেন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন না?

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ
ছবি: প্রথম আলো

‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’—এই বাণী ধারণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ শিক্ষক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন করেছিলেন গত শতকের দ্বিতীয় দশকে। তাঁরা জ্ঞানচর্চার যে শিখা প্রজ্বালন করেছিলেন, তার পথ ধরেই এ দেশে সব গণতান্ত্রিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠে।

সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন মুক্তচিন্তা ও গণতন্ত্রচর্চার সুযোগ কতটুকু আছে? গত ৩০ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভায় অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়—সেন্টার ফর জেনোসাইড ও অফিস অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক পদে ছিলেন তিনি। বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে তিনি কোনো একাডেমিক কাজে যুক্ত হতে পারবেন না।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ কি কোনো শিক্ষক ও গবেষকের বিরুদ্ধে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের নেওয়া সিদ্ধান্তের নিন্দা ও বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ সরকার-সমর্থক বেশ কিছু সংগঠন অভিযুক্ত শিক্ষকের শাস্তি দাবি করেছে।

অধ্যাপক ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ২০০৯ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা করেছেন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছেন। ইমতিয়াজের বইয়ের নাম হিস্টোরাইজিং ১৯৭১ জেনোসাইড: স্টেট ভার্সেস পারসন। এই বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য—গণহত্যার বিচারের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কের কারণে রাষ্ট্রের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। যেমন একাত্তরের গণহত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি সেনাদের বিচার করতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু যে সন্তান বাবাকে হারিয়েছেন, যে স্ত্রী স্বামীকে হারিয়েছেন, যে বোন ভাইকে হারিয়েছেন, তাঁর ক্ষত ও বেদনা কোনোভাবে মুছে ফেলা যায় না। বইয়ে গণহত্যার বিশ্লেষণের পাশাপাশি ইমতিয়াজ ১৫ জন শহীদের স্বজনদের সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছেন। অভিযোগ অস্বীকার করে এক বিবৃতিতে ইমতিয়াজ বলেছেন, ‘যে বই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত জেনোসাইডের বিচার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনোসাইড স্টাডিজ সেন্টার প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে রচিত, তাতে ১৯৭১ সালের জেনোসাইডকেই অস্বীকার কিংবা এর গুরুত্ব কমিয়ে দেখানো কীভাবে সম্ভব?’

ইমতিয়াজ আহমেদ কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিসের পরিচালক ছিলেন না, এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উদ্যোক্তাও। আন্তর্জাতিক একাডেমিক পরিমণ্ডলে জেনোসাইড সেন্টার যে পরিচিতি পেয়েছে, এর পেছনও ছিল তাঁর নিরন্তর প্রয়াস। এই সেন্টারের পরিচালক থাকাকালে তিনি বেশ কিছু সেমিনারের আয়োজন করেছেন।

এ রকম একজন শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করবেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হননি—এ কথা ইমতিয়ার বলেননি। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য আছে। ইমতিয়াজ যে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলো শহীদের সংখ্যা দিয়ে গণহত্যা বিচার করা যাবে না। গণহত্যাকে বিচার করতে হবে এর উদ্দেশ্য নিয়ে। ইমতিয়াজের বইয়ে বর্ণিত উদ্দেশ্যের সঙ্গে অনেকে একমত হবেন না। আমরা মনে করি, পাকিস্তানিদের গণহত্যার পেছনে জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণাও কাজ করেছে। কিন্তু এ জন্য তো তাঁর বই বাতিল হতে পারে না। বিতর্ক হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চের ভাষণ কী বলে শেষ করেছেন— এ বিষয়ে বইয়ে তিনি যে ভাষ্য দিয়েছেন তা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। সেদিন জনসভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই বলেছেন, ‘জয় বাংলা’ বলেই বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষ করেছেন। সরকারি ভাষ্যও তা-ই। এর ভিন্ন কিছু থাকলে সেটি প্রমাণসহ উপস্থাপন করতে হবে।

আমরা যদি ধরে নিই, ইমতিয়াজের বইয়ে তথ্যগত ভুল আছে, সেটি সংশোধন করতে বলা যেত। এমনকি যাঁরা তাঁকে পদ থেকে অপসারণ করেছেন, তাঁদের কেউ সঠিক তথ্যসমৃদ্ধ আরেকটি বই লিখেও এর জবাব দিতে পারতেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে পুলিশি দায়িত্ব করেছে, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়। সিন্ডিকেট যে পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছে, সেই কমিটিও তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করেনি। আদালতে খুনের আসামিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু ইমতিয়াজকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

অন্যদিকে, সিন্ডিকেটে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে পাঠ্যপুস্তক, সরকারের শিক্ষানীতি ও ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করার ‘অপপ্রয়াস’ চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল। ওই শিক্ষক ফেসবুকে দেওয়া তাঁর মন্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং ভবিষ্যতে এ রকম হবে না মর্মে মুচলেকা দিয়ে দায়মুক্তি পেয়েছেন।

এ এস এম আমানুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপির সমর্থক সাদা দলের নেতা। সরকার-সমর্থক নীল দলের সঙ্গেই ইমতিয়াজ আহমেদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এই দলের কোনো কোনো নেতা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদের নির্বাচনে কারও জয় বা পরাজয়ে ইমতিয়াজের ‘হাত’ ছিল। সিন্ডিকেটের ত্বরিত সিদ্ধান্তের পেছনে সেই বিবেচনাও কাজ করে থাকতে পারে।

ইমতিয়াজ আহমেদের আরেকটি পুস্তিকার শিরোনাম দ্য মারটিয়ার ইনটেলেকচুয়ালস অব দ্য ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা: ডিউরিং দ্য ১৯৭১ জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ। এই বইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষক-কর্মকর্তাদের পরিচিতি তুলে ধরার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, অপারেশন সার্চলাইটে ৫০ হাজার মানুষ নিহত হওয়া, ২ থেকে ৪ লাখ নারীর পাকিস্তানিদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার কথা বলা হয়েছে (এটি যৌথভাবে বের করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। পুলিশ বিভাগের সঙ্গেও তিনি বই করেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় প্রকাশিত ইমতিয়াজের বই দুটি আমাদের সংগ্রহে আছে।

কোনো শিক্ষক বা গবেষকের বইকে কেবল একটি দুটি শব্দ বা বাক্য দিয়ে বিচার করা যায় না, বিচার করতে হয় তাঁর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। বাংলাদেশের গণহত্যার বিচারের দাবি বহির্বিশ্বে তুলে ধরতে যে বই লেখা হয়েছে, সেই বইয়ের লেখককে এককথায় নাকচ করা কিংবা তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকারী হিসেবে চিহ্নিত করা ও শাস্তি দেওয়া আর যাই হোক সুবিচার হয়নি। অভিযোগ যত গুরুতরই হোক না কেন, তিনি কেন আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন না?

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি।

    ই–মেইল: sohrabhassan55@gmail.com