‘অলিম্পিক পদক অর্জনে অ্যাথলেটিক সংস্কৃতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফ্রিকার দেশগুলো ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে’, বিশেষ করে মধ্য ও দীর্ঘ দূরত্বের দৌড়ে পারদর্শী।’
‘অলিম্পিক পদক অর্জনে অ্যাথলেটিক সংস্কৃতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফ্রিকার দেশগুলো ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে’, বিশেষ করে মধ্য ও দীর্ঘ দূরত্বের দৌড়ে পারদর্শী।’

মতামত

অলিম্পিক পদকের ভূরাজনীতি

নির্দিষ্ট কিছু দেশ কেন মেডেল জয়ের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে অলিম্পিকে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে? অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্স এবং জিডিপির যোগসূত্র থাকার মধ্যে এই প্রশ্নের জবাব নিহিত থাকতে পারে।

২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক গেমসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, শীর্ষ সাতটি পদক বিজয়ী দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্য। এই সাত দেশ বিশ্বের ২০টি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে রয়েছে।

মেডেল জয়ের ক্ষেত্রে আংশিকভাবে জনসংখ্যার অবদানের কথাও বলা যেতে পারে, কারণ কোনো দেশের জনসংখ্যা বিপুল হলে সেখানে অ্যাথলেটিক প্রতিভার সংখ্যা বেশি থাকার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেই নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে, যে দেশ যত জনবহুল ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, তার অলিম্পিক পদক জয়ের সম্ভাবনা তত বেশি থাকে।

একটি দেশের অ্যাথলেটিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেওয়ার জন্য কার্যকর নীতি এবং পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর প্রয়োজন

এটা পরীক্ষামূলকভাবেও নিশ্চিত করা যায়। মান অনুসারে প্রতিটি দেশের মোট পদক জয়ের হিসাব ধরা হয়েছে এভাবে: স্বর্ণপদকের জন্য ৩ পয়েন্ট, রৌপ্যপদকের জন্য ২ পয়েন্ট এবং ব্রোঞ্জপদকের জন্য ১ পয়েন্ট। এই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া ১২টি দেশের সবগুলোই উন্নত অর্থনীতির দেশ।

জি-৭ ভুক্ত যে দেশগুলো বৈশ্বিক জিডিপির ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ ধারণ করে আছে, তারা এবারের অলিম্পিকের মোট পদকের ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ জিতেছে। বিশ্ব অর্থনীতির ৩ শতাংশের মালিকানায় থাকা আফ্রিকা অলিম্পিকের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ মেডেল দখল করেছে। আর বৈশ্বিক জিডিপির ৭ দশমিক ৩ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করা লাতিন আমেরিকা মাত্র ৬ শতাংশের কম পদক পেয়েছে। লাতিন আমেরিকা সব মিলিয়ে যত পদক পেয়েছে, তার ২৯ শতাংশই পেয়েছে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল।

জিডিপি এবং অলিম্পিক পারফরম্যান্সের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটা যে খুবই জোরালো, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটিই যে ধ্রুব বা পরম বা শেষ কথা, তা কিন্তু নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথাই ধরুন: বৈশ্বিক জিডিপির মাত্র ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ইইউ সদস্যগুলোর দখলে থাকলেও তারা প্যারিস অলিম্পিকে প্রায় ৩০ শতাংশ পদক জিতেছে।

এতে বোঝা যায়, অলিম্পিকে ইউরোপীয় দেশগুলোর আধিপত্যের পেছনে আংশিকভাবে তাদের কার্যকর জাতীয় ক্রীড়ানীতি ও গভীরভাবে প্রোথিত অ্যাথলেটিক ঐতিহ্য বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। অলিম্পিকের অনেক খেলার জন্মই হয়েছে ইউরোপে। এই ঐতিহ্য থেকেও তারা উপকৃত হয়ে আসছে।

অলিম্পিক পারফরম্যান্সের জন্য এশিয়াকে কোনো একক ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝা কঠিন হবে। কারণ, এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর খুব বেশি ভিন্ন। যদিও এশিয়া ও ওশেনিয়ায় তিন প্রধান ক্রীড়াশক্তি চীন, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার আবাসস্থল; কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে অলিম্পিক জয়ের রেকর্ড তুলনামূলকভাবে নমনীয়।

জিডিপি কীভাবে অলিম্পিক শ্রেষ্ঠত্বের একটি দুর্বল অনুঘটক হতে পারে, তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় উদাহরণ হলো ভারত। ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতা বিবেচনায় দেশটি বৈশ্বিক জিডিপির ৭ দশমিক ৯ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তা সত্ত্বেও ভারত ২০২৪ অলিম্পিকে পদক বিজয়ী দেশগুলোর মধ্যে ৭১তম স্থানে রয়েছে। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার দিকে খেয়াল করুন। সেখানে ২ কোটি ৬০ লাখ লোকের বাস হলেও তারা ৫ শতাংশ পদক জিতে বিজয়ী দেশগুলোর মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ২০২৪ সালের পদক প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দিয়েছে। মূলত তাদের অর্থনৈতিক শক্তি এবং জনসংখ্যার আকারের সুবাদে তারা যথাক্রমে ১২ শতাংশ ও ১০ শতাংশ পদক জিতেছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে, বৈশ্বিক জিডিপির ২০ শতাংশের মালিক যুক্তরাষ্ট্রের মেডেল অর্জন তার অর্থনৈতিক শক্তির তুলনায় খুবই কম হয়েছে।

নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কোনো দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এবং জনসংখ্যার দিক থেকে বড় হলেই যে তারা অলিম্পিকে সাফল্য পাবে, তার নিশ্চয়তা শতভাগ দেওয়া যায় না। একটি দেশের অ্যাথলেটিক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেওয়ার জন্য কার্যকর নীতি এবং পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর প্রয়োজন। এটি আমরা বুঝতে পারি তখন, যখন দেখি অস্ট্রেলিয়ার মতো স্বল্প জনসংখ্যার দেশও তার চেয়ে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোকে ছাপিয়ে যায় আর নাইজেরিয়ার মতো ঘনবসতিপূর্ণ অনেক দেশ একটি পদকও ঝুলিতে ভরতে পারে না।

অলিম্পিক পদক অর্জনে অ্যাথলেটিক সংস্কৃতিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আফ্রিকার দেশগুলো ‘ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে’, বিশেষ করে মধ্য ও দীর্ঘ দূরত্বের দৌড়ে পারদর্শী, কারণ পূর্ব আফ্রিকার মানুষ ঐতিহ্যগত কারণে পাহাড়ি পথে ও উচ্চ-উচ্চতায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে অভ্যস্ত। দূরপাল্লার দৌড় প্রশিক্ষণের জন্য তাদের অত্যাধুনিক অবকাঠামোর দরকার হয় না। কিন্তু সাঁতার, বেড়া পার হওয়া এবং জিমন্যাস্টিকসের মতো খেলার জন্য উচ্চ স্তরের প্রশিক্ষণ সুবিধার প্রয়োজন হয়। এগুলো ধনী পশ্চিমা দেশগুলো ও চীনের সামর্থ্যের ভেতরে আছে বলে এসব খেলায় তারাই অপ্রতিরোধ্যভাবে আধিপত্য ধরে রাখতে পারে।

অলিম্পিক পদক অর্জনের এই অসমতা খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও আমাদের বেশ মূল্যবান ভূরাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে থাকে।

  • জাকি লাইদি ফ্রান্সের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সায়েন্সেস পোর একজন অধ্যাপক এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ফর ফরেন পলিসি অ্যান্ড সিকিউরিটি হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা

  •  স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত