আহমেদ হুসাইন আল-শারার (যিনি আল-জোলানি নামে বেশি পরিচিত)
আহমেদ হুসাইন আল-শারার (যিনি আল-জোলানি নামে বেশি পরিচিত)

মতামত

সিরিয়ার নতুন শাসক শারা শুরুতেই যে চমক দেখালেন

আসাদের পতনের পর দ্বিতীয় সপ্তাহ গড়িয়েছে। সিরিয়া এখনো উচ্ছ্বাস এবং নতুন দিনের আশার ঢেউয়ে ভাসছে। এই আনন্দের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন শাসক আহমেদ হুসাইন আল-শারার (যিনি আল-জোলানি নামে বেশি পরিচিত) চমকপ্রদ কর্মকাণ্ড।

সপ্তাহান্তে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের আসল সমস্যা ইরানের ইসলামি সরকার। একই সঙ্গে তিনি জানান, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে না গিয়ে কূটনীতির মাধ্যমে তাঁরা সব সমস্যার সমাধান করতে চান।

যদিও শাসনকার্য চালানো কঠিন কাজ এবং এতে অনেক বাধা আসতে পারে। তবে শারার শুরুটা খুবই আশাব্যঞ্জক মনে হচ্ছে।

শারার চিন্তাধারা বোঝার জন্য বিভিন্ন সময়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্য বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। যেমন তিনি যখন প্রতিদ্বন্দ্বী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে পরাজিত করে ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন, তখনকার বক্তব্য আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে। তাঁর ইদলিব প্রদেশ শাসনের সময়কার অভিজ্ঞতা এবং অবশেষে আসাদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিদ্রোহীরা সিরিয়ার দখল নেওয়ার পর মিডিয়াতে দেওয়া সাক্ষাৎকারগুলোও আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।

ইদলিব শাসনের সময় গত জানুয়ারিতে শারার প্রশাসন একটি সামাজিক আচরণ আইন পাস ও কার্যকর করার চেষ্টা করেছিল। ১২৮টি ধারাবিশিষ্ট এই আইন জনজীবনে কঠোর নিয়মকানুন আরোপের উদ্দেশ্যে প্রণীত হয়েছিল। এতে মদ বিক্রি ও সেবন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জনসমাগমস্থলে নারী-পুরুষের একসঙ্গে চলাফেরা নিষিদ্ধ করা হয়ছিল। স্কুলে মেয়েদের জন্য ইসলামি পোশাকবিধি রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া কফি শপে জনপ্রিয় হুক্কাসহ ধূমপান ও ক্যাসিনো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

আইনটি তখন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। সম্ভবত সে কারণে আইনটির প্রণেতারা আইনটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন।

শারা আইনটিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। একই সঙ্গে এ–ও বলেছিলেন, ‘ইসলাম প্রচারকে অগ্রাধিকার দেয়, চাপিয়ে দেওয়াকে নয়।’ তিনি আইনটি কার্যকর করার জন্য বিশেষ চাপাচাপি করেননি।

এই আইনের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে শারা তাঁর শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন, যা তাঁকে অন্যান্য ইসলামি শাসকদের থেকে আলাদা করে। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি আমরা মানুষকে ভয় দেখিয়ে ইসলামি জীবনযাপনে বাধ্য করি, তাহলে তারা আমাদের উপস্থিতিতে মুসলিম হওয়ার ভান করবে এবং আমাদের অনুপস্থিতিতে ইমান ত্যাগ করবে।’

শারা বুঝেছিলেন, ধর্ম জোর করে চাপিয়ে দেওয়া খুব একটা কাজে আসে না। ২০১৫ সালে এ ধরনের উপলব্ধি সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানও করেছিলেন। এরপর তিনি দ্রুত সৌদি আরবে সামাজিক পরিবর্তন আনতে শুরু করেন।

ইদলিব শাসনের সময় শারা তাঁর দলের কাজ নিয়ে গর্ব করতেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর প্রশাসনব্যবস্থা ইদলিবে সফলভাবে কর সংগ্রহ করেছে, বাজেট ঠিকঠাক রেখেছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো মেরামত করেছে এবং জনগণের জরুরি সেবা নিশ্চিত করেছে। পানি-বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকে শুরু করে বর্জ্য পরিষ্কার এবং স্কুল-কলেজ চালানো—সবই তারা দক্ষতার সঙ্গে করেছে।

এই সাফল্যের অভিজ্ঞতাই শারা পুরো সিরিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আসাদ যখন মস্কোতে পালিয়ে গেলেন এবং তাঁর শাসন ভেঙে পড়ল, তখন থেকেই শারা কার্যত দেশের নতুন শাসক হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

শারার স্পষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে, আর নিজের ক্ষমতার ওপর তাঁর বিশ্বাসও দৃঢ়। তিনি সিরিয়াকে সফল রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। এ জন্যই তিনি ইসলামপন্থী জনতুষ্টির রাজনীতি থেকে সরে এসেছেন। এ ধরনের রাজনীতি সাধারণত অবিরাম জিহাদ, মুক্তির প্রতিশ্রুতি এবং বিশেষত ইসরায়েলসহ অমুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ধারণার ওপর নির্ভর করে।

সিরিয়ার ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। পুরো দেশ শাসন করা অনেক কঠিন কাজ, যা কিনা শারার জনপ্রিয়তায় আঘাত করতে পারে। এতে শারা হয়তো আবার জনতুষ্টির সেই রাজনীতিতে ফিরে যেতে পারেন, যেখানে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা তৈরি করে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি থাকবে।

আসাদের পতনের পরপরই শারা এক সাক্ষাৎকারে সিএনএনকে জানিয়েছিলেন, তিনি তরুণ বয়সে আল-কায়েদায় যোগ দিয়েছিলেন; কিন্তু সেটি ছিল তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্কতার ফল। সময়ের সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। তিনি আরও বলেছিলেন, তিনি গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদে বিশ্বাসী।

শারা যখন সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর পেছনে দুটি পতাকা রেখেছিলেন। ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর শারা এবং তাঁর ইদলিবের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বাশির যখন প্রথমবার জনসমক্ষে আসেন, তখন তাঁরা তাঁদের পেছনে এই দুটি পতাকা রেখেছিলেন। এর একটি ছিল সিরিয়ার বিপ্লবের পতাকা, যা আসাদবিরোধী আন্দোলনের প্রতীক। অন্যটি ছিল তাঁদের নিজস্ব মিলিশিয়া হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) জিহাদি পতাকা।

শারা সিএনএনকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় এইচটিএসের পতাকা রাখায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। সাধারণ মানুষ এই পতাকাকে শাসকদের ভবিষ্যৎ ভাবমূর্তির সঙ্গে অসংগত বলে মনে করেছিলেন।
পরদিনই শারা ও তাঁর সহযোগীরা দ্রুত তাঁদের মিলিশিয়ার পতাকা সরিয়ে ফেলেন এবং শুধু সিরিয়ার বিপ্লবের পতাকাটি রেখে দেন। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা বার্তা দেন, তাঁরা জনগণের কথা গুরুত্বসহকারে নিয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁরা মানুষের কথা শুনতে জানেন।

শারার সবচেয়ে ভালো মন্তব্যগুলো এসেছে আরব সাংবাদিকদের সঙ্গে সাম্প্রতিক বৈঠকে। তিনি বলেছেন, তাঁর নেতৃত্বের সিরিয়ার ইরানি জনগণের সঙ্গে কোনো শত্রুতা নেই। তবে ইরানের সরকারের ‘বিপজ্জনক প্রকল্প’ তাঁর সমস্যার মূল। শারা আরও বলেন, সিরিয়া আর ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। যেহেতু ইরানি মিলিশিয়ারা সিরিয়া থেকে সরে গেছে, ইসরায়েলের এখানে হামলারও কোনো কারণ নেই। যদি কোনো সমস্যা থাকে, তিনি সেগুলোর সমাধান কূটনীতির মাধ্যমে করতে চান।

শারা রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখছেন। তিনি বলেছেন, তাঁরা চাইলে রাশিয়ার ঘাঁটিতে হামলা করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা পুরোনো ক্ষোভ ভুলে সামনে এগোতে চান। এখন লন্ডন ও ওয়াশিংটনও শারার সঙ্গে যোগাযোগ করছে।

তবে সিরিয়ার ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। পুরো দেশ শাসন করা অনেক কঠিন কাজ, যা কিনা শারার জনপ্রিয়তায় আঘাত করতে পারে। এতে শারা হয়তো আবার জনতুষ্টির সেই রাজনীতিতে ফিরে যেতে পারেন, যেখানে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা তৈরি করে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি থাকবে।

তবে যতক্ষণ তাঁরা এমন কিছু করছেন না, ততক্ষণ তাঁদের কথা আমাদের বিশ্বাস করতে হবে। একই সঙ্গে সতর্কভাবে আশাবাদী হয়ে সবাইকে তাঁদের সহযোগিতা করা উচিত এবং তাঁরা ভুল পথে গেলে পরামর্শ দেওয়া উচিত।

  • হুসেইন আবদুল-হুসেইন ফাউন্ডেশন ফর দ্য ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস (এফডিডি)-এর একজন রিসার্চ ফেলো

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ