সেন্ট পিটার্সবার্গে সাম্প্রতিক সফরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধে বিজয়ের ব্যাপারে তাঁর আত্মবিশ্বাসী আশাবাদ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। প্রতিরক্ষা বিষয়ে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে তিনি এটা বলার সুযোগ হাতছাড়া করেননি, বিশেষ সামরিক অভিযান জাতিগত রাশিয়ান ও ইউক্রেনের রুশভাষী জনগণের বিরুদ্ধে কিয়েভের ‘নব্য নাৎসিবাদী শাসন’ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যই চলছে।
পুতিনের এ বক্তব্যের অন্য অর্থ হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মহান দেশপ্রেমমূলক যে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন নাৎসি জার্মানির হাত থেকে ইউরোপকে রক্ষা করেছিল, রাশিয়া এখন সেই কাজই করছে।
মস্কোয় একটি সংবাদ সম্মেলনে পুতিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ একই ভাষায় কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘নেপোলিয়ন রাশিয়ান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রায় পুরো ইউরোপকে সমবেত করেছিলেন। হিটলার ইউরোপের বেশির ভাগ রাষ্ট্র দখল করে তাদের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে পরিচালিত করেছিলেন। নেপোলিয়ন ও হিটলারের মতো যুক্তরাষ্ট্র এখন ন্যাটোর সব কটি ইউরোপীয় সদস্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে ব্যবহার করছে। হিটলার যেমন ইহুদি প্রশ্নের শেষ ফয়সালা করতে চেয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট এখন রাশিয়ান প্রশ্নের চূড়ান্ত ফয়সালার উদ্দেশ্য নিয়ে নেমেছে।
রাশিয়ার তথ্যযুদ্ধ স্পষ্টত পশ্চিমা কতিপয় নীতিনির্ধারকদের ওপর কিছুটা হলেও প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে। ইউক্রেনকে কতটা পর্যন্ত সামরিক সহযোগিতা দেওয়া হবে, সেই বিতর্ক চলমান থাকছে। ফলে কিয়েভের হাতে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে জোরালো মতৈক্য না হওয়ায় ট্রাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যানের সরবরাহও ধীর গতিতে এগোচ্ছে।
পুতিন কিংবা লাভরভের এই বয়ান মূলত রাশিয়ান নাগরিকদের উদ্দেশ্য করেই বলা। এই যুদ্ধ যে ন্যায়সংগত এবং এতে বিজয় অনিবার্য—রাশিয়ানদের সেই বুঝটাই দিতে চান তাঁরা। কিন্তু এ বক্তব্যে একই সঙ্গে ইউক্রেন ও দেশটির মিত্রদের বার্তা দেওয়া হচ্ছে। সেটি হলো, রাশিয়া লড়াইয়ের ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধের তুলনার অর্থ হলো, রাশিয়া যে শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে অবিচলভাবে, সেই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করা।
এসব প্রোপাগান্ডা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারত, কিন্তু তা করা যাচ্ছে না। কেননা সম্প্রতি রাশিয়া এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে করে এটা দৃশ্যমান যে ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্র এবং অন্যত্র সংঘাতের তীব্রতা বাড়ানোর ইচ্ছা ও সামর্থ্য দুটোই রয়েছে ক্রেমলিনের।
ইউক্রেন ও মলদোভার সীমান্তে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন ভূখণ্ড ট্রান্সনিস্তরিয়া অঞ্চলে রাশিয়া সম্প্রতি এক কন্টিনজেন্ট সেনা নিয়োগ করেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে অর্গানাইজেশন ফর কো-অপারেশন অ্যান্ড সিকিউরিটি ইন ইউরোপে (ওএনসিই) মালদোভার যুক্ত হওয়ায় বিরোধিতা করে রাশিয়া। সংস্থাটির ৫৭ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে এটি একমাত্র বিরোধিতাকারী।
দনবাস ও দক্ষিণ ইউক্রেনে রাশিয়া যদি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে ট্রান্সনিস্তরিয়ায় সেনা মোতায়েন মালদোভার জন্য সতর্কবার্তা। জাতিগত রাশিয়ান ও রুশভাষীদের রক্ষায় পুতিন মালদোভাকেই পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু বানাতে চাইবেন।
অস্থিতিশীলতা তৈরিতে রাশিয়ানদের প্রচেষ্টার ব্যাপারে মালদোভার প্রেসিডেন্ট মায়া সান্দু যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। ট্রান্সনিস্তরিয়া অঞ্চলে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ এবং ছদ্মবেশে প্ররোচনামূলক বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। উদ্বিগ্ন মায়া সান্দু পশ্চিমা মিত্রদের কাছে আকাশ নজরদারি ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা চেয়েছেন।
কয়েক মাস আগে কিয়েভে রাশিয়ার সেনারা যে বিপর্যয়ের মুখে অপমানকর পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হওয়ার পর থেকেই রাশিয়া বারবার ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা যুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট বা ক্ষেত্র খুলতে চলেছে। গত বছরের শেষ দিকে পুতিন মিনস্ক সফরে যান। এর পরেই দুই দেশের সেনারা যৌথ মহড়ায় অংশ নেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির সতর্ক করে বলেন, বেলারুশ থেকে রাশিয়া স্থল আগ্রাসন শুরু করতে পারে।
সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধে সেনা নেতৃত্ব পুনর্গঠনও করেছেন পুতিন। বিমানবাহিনীর জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনকে সরিয়ে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর সেনাধ্যক্ষ জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভকে পুনর্বহাল করা হয়েছে। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ক্রিমিয়াকে অবৈধভাবে রাশিয়ার অংশ করার অভিযান তত্ত্বাবধান করেছিলেন গেরাসিমভ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের স্থপতিও ছিলেন তিনি। গেরাসিমভকে আবার ইউক্রেন যুদ্ধের নেতৃত্বে বসানোর অর্থ হচ্ছে, রাশিয়া আরও শক্ত ঝাঁকুনি দিতে চায়।
এরই মধ্যে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ পারমাণবিক যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়িয়ে আগুনে আরও ঘি ঢেলেছেন। এ ছাড়া পুতিনের মুখপত্র দিমিত্রি পেসকভ ইঙ্গিত দিয়েছেন, কিয়েভ যদি মস্কোর শর্ত মেনে নেয়, তাহলেই কেবল রাশিয়া যুদ্ধ থামাবে।
এ বক্তব্যকেও অর্থহীন প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেওয়া যেত, কিন্তু সেটা ওড়ানো যাচ্ছে না। কেননা বাস্তবেও ইউক্রেন ও অন্যত্র রাশিয়া উত্তেজনার পারদ চড়ানোর চেষ্টা করছে। নববর্ষের ভাষণেও পুতিন চলমান যুদ্ধকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার সভ্যতার সংঘাত বলে বর্ণনা করেছেন। পুতিন তাঁর বক্তব্যের বেশির ভাগ অংশে পশ্চিমা নেতাদের বার্তা দিতে চেয়েছেন। সম্প্রতি তাঁরা দাভোসে সমবেত হন এবং ইউক্রেনে অতিরিক্ত সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা উচিত কি না, সেটিসহ আরও বিষয়ে বিতর্ক করেন।
রাশিয়ার তথ্যযুদ্ধ স্পষ্টত পশ্চিমা কতিপয় নীতিনির্ধারকদের ওপর কিছুটা হলেও প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে। ইউক্রেনকে কতটা পর্যন্ত সামরিক সহযোগিতা দেওয়া হবে, সেই বিতর্ক চলমান থাকছে। ফলে কিয়েভের হাতে এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মধ্যে জোরালো মতৈক্য না হওয়ায় ট্রাংক ও অন্যান্য সাঁজোয়া যানের সরবরাহও ধীর গতিতে এগোচ্ছে।
রাশিয়ার অপতথ্য ও অপতৎপরতায় বিভ্রান্ত না হয়ে ইউক্রেনের মিত্রদেশগুলোর উচিত বলিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণ করা। সেটা কার্যকরভাবে করতে গেলে কিয়েভকে আরও বেশি এবং উন্নত অস্ত্র ও গোলাবারুদ জোগান দিতে হবে।
সেটা না হলে ইউক্রেন নিজেদের দখলকৃত ভূখণ্ড রাশিয়ার হাত থেকে মুক্ত করতে পারবে না। চিত্রনাট্যে এটাই হতে পারে সবচেয়ে ভালো দৃশ্য। আর সবচেয়ে খারাপ দৃশ্যটা হতে পারে, পুতিন যদি আগামী কয়েক মাসের মধ্যে স্থলপথে নতুন আগ্রাসন শুরু করে।
স্টেফান উলফ যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে