নির্বাচন বাংলাদেশে, মারামারি আমেরিকায় 

আমেরিকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থকেরা সংঘর্ষে জড়ান
ছবি: ফেসবুক ভিডিও থেকে সংগৃহীত

২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের খবর সংগ্রহ করতে নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম। তবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী হিসেবে নয়। একদিন জাতিসংঘ ভবনের সামনে যেতেই দেখলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেদিন ভাষণ দেবেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা সমবেত হয়েছেন। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। এক পক্ষ ‘খালেদা জিয়া ফিরে যাও’ ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্য পক্ষের ব্যানারে লেখা ছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শুভেচ্ছা স্বাগতম’। নেতা-কর্মীরা পাল্টাপাল্টি স্লোগানও দিচ্ছিলেন। তাঁরা আধা ঘণ্টা সময় ধরে নিজ নিজ কর্মসূচি পালন করছিলেন। কোনো হাঙ্গামা হয়নি। বরং একসময় দেখলাম, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা হাসিমুখে কুশল বিনিময় করছেন। সঙ্গে নিয়ে আসা কেক-বার্গার-পেটিস ভাগ করে খাচ্ছেন। 

প্রতিবছরই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা এ ধরনের কর্মসূচি পালন করে থাকেন। আবার ঈদ, পূজা, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানও একসঙ্গে উদ্‌যাপন করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে দেশের মতো প্রবাসেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরা যে ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’, ১ মের ঘটনায় তা আবারও প্রমাণিত হলো। এখন আর তাঁরা কেক-পেটিস-বার্গার ভাগাভাগি করে খান না। ব্যানার, লাঠি, হাতমাইক নিয়ে এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।  

স্থানীয় সময় ১ মে সকালে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের অংশীদারত্বের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় কার্যালয়ের বাইরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করতে থাকেন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। একই স্থানে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতা-কর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানিয়ে সমাবেশের আয়োজন করেন। একপর্যায়ে দুই পক্ষের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়। এতে দুই দলের বেশ কয়েকজন আহত হন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খবরটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশকেও হিমশিম খেতে হয়। তারা কয়েকজনকে আটক করে। পরে নেতাদের অনুরোধে তাঁদের ছেড়ে দেয়। 

বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনী বিরোধ নিয়ে দেশের বাইরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মারামারি-হাতাহাতির ঘটনা অত্যন্ত লজ্জাজনক। যেসব বিদেশি নাগরিক সেদিনের মারামারির ঘটনা দেখেছেন, তাঁরা বাংলাদেশ সম্পর্কে কী ধারণা করবেন? ওয়াশিংটনে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হলো, তারও কারণ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। বিএনপির দাবি, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না, অতএব নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। 

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে বাইরের লোককে আমরা এত কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছি। আমাদের নেতারা নির্বাচনের বিষয়ে জনগণের সঙ্গে কথা বলেন না, তাঁদের মনোভাব জানতেও চান না। তাঁরা কথা বলেন ‘বিদেশি বন্ধুদের’ সঙ্গে।

দেশের নির্বাচন নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দিল্লি, বেইজিং, মস্কো, ওয়াশিংটন, টোকিও, ব্রাসেলস পর্যন্ত উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কোনো দেশের বিবৃতি যে দলের পক্ষে যায়, সেই দল আহ্লাদিত হয়। যে দলের বিপক্ষে যায়, তারা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে প্রায়ই বাংলাদেশের নির্বাচন, মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ  ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা। এসব প্রশ্ন ও  উত্তর নিশ্চয়ই আমাদের জন্য সুখকর নয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে বাইরের লোককে আমরা এত কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছি। আমাদের নেতারা নির্বাচনের বিষয়ে জনগণের সঙ্গে কথা বলেন না, তাঁদের মনোভাব জানতেও চান না। তাঁরা কথা বলেন ‘বিদেশি বন্ধুদের’ সঙ্গে। 

গত বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারত্ব সংলাপেও প্রাধান্য পায় নির্বাচনের বিষয়টি। প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার বিষয়ে আবারও আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই সংলাপে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে রাজনীতিবিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড নেতৃত্ব দেন। 

গত এপ্রিলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের মধ্যে যে বৈঠক হয়, তাতেও নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল। এমনকি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে তাঁর প্রতিপক্ষের সহযোগিতাও চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, শুধু সরকার ও নির্বাচন কমিশনের একার চেষ্টায় সম্ভব নয়। এ জন্য সব দল ও মতের লোকের ঐকান্তিকতা, আন্তরিকতা, অঙ্গীকার থাকতে হবে। জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সারা বিশ্বের দৃষ্টি রয়েছে। এ অঞ্চল এবং সারা বিশ্বের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়, তা নিশ্চিতের বিষয়ে সবার মনোযোগ রয়েছে।

আমরা ভেবেছিলাম দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘চূড়ান্ত’ বৈঠকের পর দ্বিপক্ষীয় অংশীদারত্ব সংলাপে নির্বাচন নিয়ে আর কথা হবে না। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব ও মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারির মধ্যে যে বৈঠক হয়েছে, তাতেও ফের নির্বাচন ও মানবাধিকারের বিষয়টি এসেছে। 

আমরা কি এ কথা কখনো ভাবতে পারি, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্যের নির্বাচন নিয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা পররাষ্ট্রসচিবেরা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে তাঁদের দেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষা, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। ওই রাষ্ট্রগুলো কি তা কখনো মেনে নেবে? আমরা মেনে নিচ্ছি এ কারণে যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও একটি ত্রুটিমুক্ত, সর্বজনস্বীকৃত নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। আমরা বিরোধী দলে থাকতে গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচনের একরকম সংজ্ঞা ঠিক করি, ক্ষমতায় গেলে আরেক রকম। 

এ স্ববিরোধিতা ও আত্মপ্রতারণা থেকে মুক্ত হতে না পারলে বিশ্বের সব দেশই গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে আমাদের সবক দিয়ে যাবে। পছন্দ হোক আর না হোক, সেটা মুখ বুজে নেতা–নেত্রীরা সহ্য করতে থাকবেন।  

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com