হজ কবুল হওয়া ও হজের পরের জীবন

হজ ইসলামের মূল পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেসব মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান; আয়াত: ৯৭)

পবিত্র হজ আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ বিধান। আল্লাহ হজ পালনের মধ্যে মহান উদ্দেশ্য নিহিত রেখেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হজ মাবরুরের পুরস্কার জান্নাত ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না। তাঁর কাছে জিজ্ঞাসা করা হলো, হজ মাবরুর কী? তিনি বললেন, (হজে) খানা খাওয়ানো, সালাম দেওয়া (শান্তি রক্ষা) ও সুন্দর কথা বলা। (বুখারি: ২৮১৯ ও মুসলিম)।

সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁরা হজ পালন করবেন, আল্লাহপাক তাঁদের হজ কবুল করবেন এবং তাঁদের জন্য অফুরন্ত রহমত ও বরকত অবধারিত। কবুল হওয়া বা না হওয়ার আলোকে হজ তিন প্রকার। যথা: হজে মাবরুর, হজে মাকবুল ও হজে মারদুদ।

হজ একটি ফরজ ইবাদত, এটি কোনো সার্টিফিকেট কোর্স নয় এবং কোনো পদ–পদবি বা উপাধি নয়। হজ করার পর নিজ থেকেই নামের সঙ্গে হাজি বিশেষণ যোগ করা সমীচীন নয়

হজে মাবরুর মানে হলো সর্বোত্তম হজ; যে হজ সব মানদণ্ডে শতভাগ মানোত্তীর্ণ। হজে মাকবুল মানে কবুল হজ বা যে হজ কবুল হয়েছে। হজে মারদুদ মানে হলো রদ তথা পরিত্যাজ্য বা পরিত্যক্ত অর্থাৎ বাতিলকৃত হজ।

নিয়ত বিশুদ্ধ না হলে বা উদ্দেশ্য সঠিক না থাকলে, হজের অর্থ হালাল না হলে বা বৈধ উপার্জন না হলে, হজের ফরজ, ওয়াজিব তথা আরকান আহকাম সঠিকভাবে আদায় করা না হলে, হজের সময় নিষিদ্ধ কোনো কর্ম করলে হজ বাতিল হতে পারে। সর্বোপরি হজের শিক্ষা অর্জন না করলে বা হজের উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হলে হজ বাতিল হিসেবে গণ্য হবে।

আল্লাহ তাআলা কাবাঘর স্থাপনের পর হজরত জিবরাইল (আ.)–কে হজের জন্য আজান বা ঘোষণা দিতে বললেন। আল্লাহর নির্দেশে হজরত জিবরাইল (আ.) হজের জন্য আহ্বান করলেন। সেই আহ্বানের ধ্বনি আল্লাহপাক সারা বিশ্বে ও রুহের জগতে পৌঁছে দিলেন।

সেই আহ্বানধ্বনি শুনে যেসব রুহ সাড়া দিয়ে ‘লাব্বাইক’ বলেছিল, তারা হজ করার সুযোগ পাবে। এ প্রকার হাজিদের হজ হবে ‘মাবরুর’ অর্থাৎ উত্তম হজ।

কাবাঘর পুনর্নির্মাণের পর হজরত ইব্রাহিম (আ.)–কে আল্লাহ তাআলা হজের আহ্বানের নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘আর তুমি মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা করে দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রপৃষ্ঠে; তারা আসবে দূর–দূরপাল্লার পথ অতিক্রম করে।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ২৭)

আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) জাবালে আবু কুবাইস থেকে হজের আহ্বান জানালেন। আল্লাহ তাআলা এই আহ্বানধ্বনি সমগ্র বিশ্বে ও রুহের জগতে পৌঁছে দিলেন। এ আহ্বানধ্বনি শুনে যেসব রুহ সাড়া দিয়ে ‘লাব্বাইক’ বলেছিল, তারা হজ করার সুযোগ পাবে। এ প্রকার হাজিদের হজ হবে ‘মাকবুল’ তথা কবুল হজ।

অতঃপর ইবলিস শয়তান আল্লাহ তাআলার কাছে অনুরূপ আহ্বানের অনুমতি চাইলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকেও আহ্বানের অনুমতি দিলেন। যারা পূর্বের দুটি আহ্বানে সাড়া দেয়নি এবং এই শয়তানি আহ্বানের জবাব দিয়েছে, তারাও হজ করার সুযোগ পাবে। এদের হজ হবে ‘মারদুদ’ বা বাতিল হজ। কোন হাজির হজ কোন প্রকার হয়েছে, তা হাজির হজ–পরবর্তী জীবনাচার দেখে অনুমান করা যাবে।

হজ মাবরুরের জন্য প্রিয় নবীজি (সা.) দোয়া করেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের হজ মাবরুর নসিব করুন, আমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দিন, আমাদের সৎ প্রচেষ্টা মূল্যায়ন করুন, নেক আমলগুলো মাকবুল (কবুল) করুন এবং (ইহজগতে ও পরকালে) এমন লাভজনক ব্যবসায় সফলতা দিন, যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নয়।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)

যাঁরা হজের শিক্ষা লাভে ধন্য হন, তাঁরাই প্রকৃত হাজি। যাঁরা হজকে জীবন পরিবর্তনের অপূর্ব সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং হজ–পরবর্তী জীবনে হজের শিক্ষা বজায় রেখে জীবন পরিচালনা করেন। এরূপ হাজির সংখ্যা বাড়লে দেশ ও জাতির মঙ্গল সাধিত হবে, জনমানুষের কল্যাণ হবে; অন্যথা অর্থের অপচয়, সময়ের অপচয়, শক্তি–সামর্থ্যের অপব্যবহার ও নফসের গোলামি বা আত্মপূজাই সার হবে।

হজ একটি ফরজ ইবাদত, এটি কোনো সার্টিফিকেট কোর্স নয় এবং কোনো পদ–পদবি বা উপাধি নয়। হজ করার পর নিজ থেকেই নামের সঙ্গে হাজি বিশেষণ যোগ করা সমীচীন নয়। অন্য কেউ তা করলে দোষ নেই।

হজের সময় হাজিদের দোয়া কবুল হয়। হজের পর ৪০ দিন দোয়া কবুল হয় এবং হাজি যত দিন গুনাহমুক্ত থাকবেন, তত দিন তাঁর দোয়া কবুল হতে থাকবে। ইনশা আল্লাহ।

  • মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

    যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

    smusmangonee@gmail.com