অফিসে আসার পথে খিলগাঁও উড়ালসড়কের তলে রোজ কিছু মানুষকে বসে থাকতে দেখি। বেশির ভাগেরই পরনে মলিন জামা ও লুঙ্গি। চেহারায় স্থায়ী বিষণ্নতা। চোখেমুখে কালশিটে পড়া অপুষ্টির স্পষ্ট রেখা। কারও হাতে কোদাল, কারও হাতে শাবল। কারও হাতে কিছুই নেই।
সবাই এক জায়গায় পাশাপাশি বসে থাকেন। তাঁরা দিনমজুর। কেউ মাটি কাটার কাজ করেন। কেউ রাজমিস্ত্রির জোগালির। মজুর হিসেবে নিজেদের এই হাটে তোলেন তাঁরা। যাঁর লোক দরকার, তিনি এসে বসে থাকা মজুরদের গা গতর দেখে বেছে বেছে (পারলে গরু কেনার মতো হাত–পা টিপে দেখতেন) লোক ঠিক করেন। ‘দরদাম’ ঠিক হলে লোক নিয়ে যান। ফুটপাতে বসা সবজিওয়ালার সব সবজি প্রতিদিন বিক্রি হয় না। কিছু অবিক্রীত থেকে যায়।
ঠিক সেই রকম বিষণ্ন মুখে বসে থাকা এই মানুষগুলোর সবাই কাজ পান না। কেউ কেউ অবিক্রীত সবজির মতো দুপুর নাগাদ পড়ে থাকেন। শেষে কাজ না পেয়ে বিষণ্ন মুখকে বিষণ্নতর করে চলে যান। ওই পথ দিয়ে আসতে আসতে সড়ক বিভাজকের ওপর লাইন ধরে বসা লোকগুলোকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এঁদের মধ্যে মাটিকাটা দিনমজুর জুয়েল মিয়াও কি এসে বসতেন?
আমি যে জুয়েল মিয়ার কথা বলছি, তিনি অবশ্য খিলগাঁওয়ে থাকতেন না। তিনি আর তাঁর ২২ বছর বয়সী স্ত্রী নাসরিন আক্তার ভাড়া থাকতেন পূর্ব রামপুরার তিতাস রোডের একটা টিনশেড ঘরে। গত মঙ্গলবার গভীর রাতে সেই ঘরের ফ্যানে একই সঙ্গে ফাঁস লাগানো অবস্থায় তাঁদের নিথর দেহ পুলিশ উদ্ধার করেছে। এই দম্পতির আত্মীয়স্বজন আর পুলিশের কথা থেকে যে তথ্য জানতে পারছি, সেই তথ্যই খিলগাঁওয়ের দিনমজুরের হাটে জুয়েল এসে বসতেন কি না—এমন ভাবনা আমার মাথায় নিয়ে আসছিল।
তিন বছর আগে কুড়িগ্রামের ছেলে জুয়েল আর কিশোরগঞ্জের নিকলীর মেয়ে নাসরিনের বিয়ে হয়েছিল। তাঁরা গাজীপুরে থাকতেন। জুয়েল হিউম্যান হলার-লেগুনা চালাতেন। কিন্তু ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার কারণে কিছুদিন আগে বেকার হয়ে পড়েন। আয়রোজগার বন্ধ হওয়ায় সংসার চলছিল না।
এ অবস্থায় মাস কয়েক আগে নাসরিনের ভাই টিটু মিয়া বোন-ভগ্নিপতিকে গাজীপুর থেকে রামপুরার তিতাস রোডে তাঁর পাশের বাসায় নিয়ে আসেন। এখানে থেকেই জুয়েল মাটিকাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন দিন ধরে মজুরের হাটে গিয়েও কাজ জুটছিল না। দুই মাসের ঘর ভাড়া বাকি পড়ে গিয়েছিল। জুয়েল চড়া সুদে ৩০ হাজার টাকা ঋণ করেছিলেন। প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা করে কিস্তি দিতে হচ্ছিল।
টিটু মিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার সারা দিনে জুয়েল-নাসরিনের বাসায় কোনো রান্নাই হয়নি। রামপুরা থানার ওসির ভাষ্য, তাঁদের আর্থিক সংকট ছিল। এ কারণে স্বামী-স্ত্রী দুজন আত্মহত্যা করেছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে তাঁদের মনে হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, জুয়েল-নাসরিন দারিদ্র্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন। পেটে খিদে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভিক্ষা করতে পারেননি। ফলে ‘ভালো খাওয়া-ভালো পরা’ লোকদের প্রতি তীব্র অভিমান নিয়ে তাঁরা পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন।
প্রথম আলোতে এই খবরের ঠিক পাশেই আরেকটি খবর ছাপা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তায় আমাদের একটি সফলতার গল্প আছে। বাংলাদেশ কৃষি ও শিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করতে পেরেছে।’
দুর্নীতির অর্থ দেশে বিনিয়োগ না হয়ে চলে গেছে দেশের বাইরে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু সর্বজনীন উন্নয়ন প্রকৃত প্রস্তাবে এখনো অধরাই থেকে গেছে। তাই এত উন্নয়নের মধ্যেও গত মঙ্গলবার জুয়েল-নাসরিনের বাসায় সারা দিন রান্না হয়নি; এই কারণেই গত বছর ঢাকা শহরের মোট দরিদ্রের ৫১ শতাংশই ছিল নতুন দরিদ্র।
বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের খাদ্য অধিকার ও কৃষি খাদ্যব্যবস্থা সম্মেলন ২০২৩-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্পিকার এ কথা বলেন। ওই সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেছেন, খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রভূত উন্নতি করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি ‘সাকসেস স্টোরি’। সমস্যা হলো, জুয়েল মিয়া ও নাসরিনের মতো বহু মানুষ সেই ‘সাকসেস স্টোরি’ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন। চাল-ডালের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে আয়রোজগার বাড়া দূরে থাক, অনেকের চাকরিই থাকছে না। পুত্র হয়ে যাচ্ছে পিতার চেয়ে গরিব।
গত মে মাসে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ঢাকায় নতুন দারিদ্র্যের আবির্ভাব ঘটেছে। গত বছর এই শহরের মোট দরিদ্রের ৫১ শতাংশই ছিল নতুন দরিদ্র। তারা বলেছে, নিম্ন আয়ের পরিবারের ঢাকার অনেক শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে।
বিআইডিএসের এই গল্পের সঙ্গে দেশের খাদ্য উৎপাদনবিষয়ক ‘সাকসেস স্টোরি’র মিল থাকছে না।
চুইয়ে পড়া অর্থনীতির যে ধারণার কথা ইদানীং খুব শোনা যায়, ভাসা–ভাসা জ্ঞানে তার অর্থ যতটুকু বুঝেছি, তা হলো: উন্নয়ন আর দুর্নীতি মাসতুতো ভাই। বিরাট বিরাট প্রজেক্ট পাস হবে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে।
কিছু লোক অর্থের পিরামিড গড়বে। সেই পিরামিড বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে কিছু খুদকুঁড়া পড়বে। তাতেই পিরামিডের তলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোক খেয়ে–পরে ভালো থাকবে।
তার মানে, দেশের দুর্নীতির কালোটাকা দেশেই বিনিয়োগ হলে তার একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ হলেও জুয়েল-নাসরিনদের পাতে পড়ার কথা। কালোটাকায় কলকারখানা উঠলে, সেখানে তাঁদের শ্রমিক হিসেবে কাজ পাওয়ার কথা।
চুইয়ে পড়া টাকা বেতন হিসেবে তাঁদের গাঁটে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ওপরতলার উন্নয়ন থেকে যথেষ্ট পরিমাণে চুইয়ে পড়েনি।
দুর্নীতির অর্থ দেশে বিনিয়োগ না হয়ে চলে গেছে দেশের বাইরে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু সর্বজনীন উন্নয়ন প্রকৃত প্রস্তাবে এখনো অধরাই থেকে গেছে। তাই এত উন্নয়নের মধ্যেও গত মঙ্গলবার জুয়েল-নাসরিনের বাসায় সারা দিন রান্না হয়নি; এই কারণেই গত বছর ঢাকা শহরের মোট দরিদ্রের ৫১ শতাংশই ছিল নতুন দরিদ্র।
আমরা স্বভাবত নতোদর ও উদরপরায়ণ। খেতে বড় ভালোবাসি। শুধু খেতে ভালোবাসি না, পেট ভরে খেয়ে বড় করে ঢেকুর তোলাতেও আমাদের বিশেষ খ্যাতি আছে। সশব্দ তৃপ্তিদায়ক উদ্গারের আলস্যে এতকাল ধরে আমরা ‘গোটাটাই খাব’ মানসিকতা ধরে রেখেছি। তার সর্বশেষ বলি জুয়েল ও নাসরিন।
সভা সেমিনারে আওড়ানো উন্নয়নের ‘সাকসেস স্টোরির’ নিচে এ রকম আরও কত জুয়েল-নাসরিনের গল্প চাপা পড়ে যাচ্ছে কে জানে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com