অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হবে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির কাঠামো কেমন হবে। বিএনপির মহাসচিব ইতিমধ্যে বলে দিয়েছেন, তাঁরা জাতীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি চলুক, সেটাই চান। অন্যরা এখনো সরাসরি কোনো মতামত দেননি। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে দাপিয়ে বেড়ানো লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনির্ধারিত। কিন্তু ছাত্রশিবির আর ছাত্রদল এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে।
ফলে বোঝা যাচ্ছে, বর্তমানে বড় দুটি রাজনৈতিক দল চাচ্ছে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি চালু থাকুক। কিন্তু আমার মতো অনেক লোকের প্রশ্ন, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে এর প্রয়োজন কতটুকু?
প্রসঙ্গক্রমে আমরা যদি দেশের গত ৭৭ বছরের ছাত্ররাজনীতি বিশ্লেষণ করি তবে দেখতে পাব, ছাত্ররাজনীতি আমাদের কী দিয়েছে, আর ছাত্ররাজনীতির কারণে আমরা কী হারিয়েছি।
প্রথমে বলা যাক, ছাত্ররাজনীতি থেকে আমরা কী কী পেয়েছি। বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, বড় বড় বিপ্লব ও গণ–আন্দোলনগুলোতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের গণ–অভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার বিপ্লবে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অতএব বলা যেতে পারে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাজনীতি আমাদের দেশের জন্য অতীতে অমূল্য অবদান রেখেছে। অতএব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত বলে অনেকে মনে করেন।
অনেকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতীয় নেতা তৈরি করার কারিগর। দেশের বড় বড় নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি শিখেছেন এবং পরবর্তী সময়ে জাতীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। অতএব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি থাকতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে কথাগুলো বেশ যৌক্তিক ও গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
আমরা যদি প্রতিটি যুক্তিকে আলাদাভাবে খণ্ডন করি, তবে কি আমরা একই অবস্থানে থাকব, তাই দেখা যাক। প্রথমেই বলে রাখি, আমার এই লেখা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে নয় বরং লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষকরাজনীতির বিরুদ্ধে। ছাত্র আন্দোলন ও দলীয় রাজনীতি: মূল আলোচনায় ফিরে আসা যাক। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে দেখছি ঠিক, কিন্তু কোনো দলের ব্যানারে নয়।
১৯৫২–এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০–এর গণ–অভ্যুত্থান, ২০১৮–এর কোটাবিরোধী আন্দোলন ও ২০২৪–এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এর কোনোটিতেই কোনো লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠন নেতৃত্ব দেয়নি। বরং সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলন হয়েছে। সাধারণ ছাত্রদের অংশগ্রহণই এই আন্দোলনগুলোর বৈধতা দিতে সহায়তা করেছে এবং এতে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে।
এটি প্রমাণ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে কোনো দলের ট্যাগ লাগে না। তাদের প্রয়োজন হয় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর। যখনই ছাত্ররা দেখেছে জাতীয় ইস্যু যেমন রাষ্ট্রীয় ভাষার আন্দোলন, স্বাধীনতার যুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, চাকরিতে নিয়োগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও ফ্যাসিজম থেকে মুক্তির আন্দোলনে তাদের প্রয়োজন হয়েছে, তখনই তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
কোনো রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র আন্দোলনকে আমরা ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলনে ডাক দিতে দেখিনি। ২০২৪ সালের ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ও কোনো রাজনৈতিক ব্যানারে হয়নি। বরং কোনো রাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে হলে ২০১৮ সালের ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের’ কোটাবিরোধী আন্দোলন বা ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান কোনোটাই সফল হতো না।
আমরা হয়তো কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রদের থেকে বেশি বেশি জাতীয় নেতা বেরিয়ে আসতে দেখে ভাবছি লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি জাতীয় নেতা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। ধারণাটি আসলে ঠিক নয়। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নয়, বরং উচ্চশিক্ষাই তাদের জাতীয় নেতা হতে সাহায্য করেছে।
তা ছাড়া কবি হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতার একটি অমর লাইন ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ এখানে প্রাসঙ্গিক। প্রাকৃতিক নিয়মে যুবকরাই হয় জুলুম–নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ছাত্রদের জাতীয় ইস্যুতে নেতৃত্ব দেওয়া সে কারণেও হয়েছে। তারুণ্য অন্যায় সহ্য করতে চায় না।
আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপের দেশগুলোতে কি নেতা তৈরি হয় না? সেখানেও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বা ছাত্রসংসদ রয়েছে। কিন্তু আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলোতে যেমন রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাটদের লেজুড়বৃত্তি নেই, ইংল্যান্ডে ও তেমন লেবার পার্টি বা কনজারভেটিভ দলের লেজুড়বৃত্তি নেই। কানাডা বা অস্ট্রেলিয়াতেও তাই। আমি কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কানাডার অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কেও আমার কমবেশি জানা আছে।
এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লিবারেল বা কনজারভেটিভ দলের লেজুড়বৃত্তি কেউ করে না। কিন্তু জাতীয় নেতাদের সবাই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। তাই কি প্রমাণ করে না, নেতা তৈরিতে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনের কোনো প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশে আমাদের নেতাদের গদিতে যাওয়া বা গদি রক্ষার জন্যই এই লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির সৃষ্টি।
আমরা যদি অতীতে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি কি ভূমিকা রেখেছে তা আলোচনা করি তাতে সহজেই বোঝা যাবে, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকা উচিত কি না।
আমরা অতীতে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনের হল দখল ও ক্যাম্পাস দখলকে কেন্দ্র করে অগণিত ছাত্রকে ক্যাম্পাসে খুন ও আহত হতে দেখেছি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনের দুই দলের বা একই দলের দুই গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর মাসের পর মাস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকতে দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাই লম্বা সময়ের সেশনজট সৃষ্টি করেছে, যা ছাত্রদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অকারণে নষ্ট করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলোগুলোতে সিট বরাদ্দে চলে রাজনৈতিক দলীয় কোটার ব্যবহার। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলো সাধারণ ছাত্রদের হলোগুলোতে থাকতে দেয় না। যারা থাকে, তাদের বাধ্যতামূলক যেতে হয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনের মিছিল-মিটিংয়ে।
উন্নত দেশগুলোতে আমরা দেখি শিক্ষকদের পরিচয় হলো: কোন শিক্ষক গবেষণায় কতটা ভালো, কোন শিক্ষক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কী কী অবদান রেখেছেন, কোন শিক্ষক কতটা ভালো পড়ান, কোন শিক্ষক কতটা ছাত্রবান্ধব, কোন শিক্ষকের গবেষণা নেটওয়ার্ক কত বড়, কোন শিক্ষক কতটি ‘গবেষণা অনুদান’ পেয়েছেন ও কতজন ছাত্রকে সুপারভাইজ করেছেন, ইত্যাদি।
জানা যায়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ডিন, সহ–উপাচার্য বা উপাচার্য হওয়ার জন্য লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন।
শিক্ষকদের পৃষ্ঠপোষকতায় একই দলের নাকি বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি হয় যা রাজনৈতিক শিক্ষকেরা নিজেদের স্বার্থকে চরিতার্থ করতে কাজে লাগান। নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, শিক্ষকদের মূল কাজ শিক্ষকতা ও গবেষণা বাদ দিয়ে তারা ছাত্রসংগঠনের ক্যাডারদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। এতে তাঁদের মান সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিতেও তাঁরা কার্পণ্য করেন না।
জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজেদের দায়দায়িত্ব ভুলে গিয়ে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে, গবেষণা না করে, ছাত্রদের সময় না দিয়ে, বরং ডিন, সহ–উপাচার্য আর উপাচার্য হতে, শিক্ষক সমিতির পদ পেতে, সিন্ডিকেট সদস্য হতে শিখিয়েছে। কোন শিক্ষক কোন দলের, এটাই আজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পরিচয়।
তাই জাতীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষকরাজনীতিও বন্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষাঙ্গনে তাদের দলীয় নেতাদের নিয়ে আসে। একদিকে ক্লাস চলছে, পরীক্ষা হচ্ছে; অন্যদিকে চলছে মিটিং, মিছিল, স্লোগান ইত্যাদি, এমনটাই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে। শিক্ষার পরিবেশ কোথায়? দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নয় বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ নয়, এমপি, মন্ত্রীরা ঠিক করে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহউপাচার্য বা ডিন কারা হবেন।
সে ক্ষেত্রে মূল্যায়ন হয় কোন শিক্ষক দলের কতটা অনুগত। শিক্ষা ও গবেষণায় কোন শিক্ষকের অবদান সে ক্ষেত্রে তেমন বড় ভূমিকা রাখে না। তাইতো আমরা একজন উপাচার্যকে বলতে শুনেছি, তাঁকে যুবলীগের সভাপতি করা হলে তিনি উপাচার্য পদটি ছেড়ে দেবেন। বোঝাই যাচ্ছে, একজন উপাচার্যকে তাঁর পদ ধরে রাখতে কী পরিমাণ তেলবাজি করতে হয়। কারণ, রাজনৈতিক বিবেচনায় ও দলীয় আনুগত্যের প্রতি যাঁরা ‘কমিটেড’, তাঁরাই উপাচার্য হন এবং হয়ে আসছেন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা নিচে নেমেছে?
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, তারা নিজেদের জন্য নয়, মানুষের কল্যাণে এবং দেশের স্বার্থে রাজনীতি করেন। আমরা মেনে নিচ্ছি যে তাঁরা সঠিক কথাই বলছেন। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি তাঁরা কীভাবে সাপোর্ট করছেন?
আমরা যদি ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়কার ছাত্ররাজনীতি দেখি, তবে দেখব ফ্যাসিবাদ ১৫ বছরের অধিক সময় টিকে থাকার অন্যতম কারণগুলোর একটি ছিল তাদের ছাত্রসংগঠন।
তাদের ছাত্রসংগঠনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিহিংসার রাজনীতি, চাঁদাবাজি আর টেন্ডারবাজি করেছে। এই ছাত্রসংগঠন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হতে দেয়নি।
তারা হল দখল করেছে, ছাত্রদের জোর করে তাদের মিটিং–মিছিলে নিয়েছে, ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, আর সাধারণ ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করে তাদের ক্ষমতার জানান দিয়েছে। যখনই সরকারের কোনো সমালোচনা হয়েছে, তার টুঁটি চেপে ধরেছে।
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার কথা বেশি দিন আগের নয়। সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ও বাক্স্বাধীনতা, মতামতের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা সবই হারিয়েছে।
যদি লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি না থাকত, তাহলে কি আবরারের মতো মেধাবী ছাত্রকে জীবন দিতে হতো? আলোচনার স্বার্থে ধরে নিচ্ছি, আর কোনো ফ্যাসিস্ট সরকারের উত্থান হবে না।
এমনকি তারপরও জাতিকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
এক. ছাত্ররা যখন দলীয় লেজুড়বৃত্তি করে, তখন তারা পড়াশোনার চাইতে বেশি ব্যস্ত থাকে হলের সিট দখলে, রাজনৈতিক নেতাদের খুশি করতে সময়ে সময়ে মিছিল–মিটিং আয়োজনে, টেন্ডারবাজিতে, দলীয় শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক, আর জাতীয় বা আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে।
বাংলাদেশের লেজুড়বৃত্তিক ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা গবেষণা না শিখে শেখে কীভাবে চাপাতি আর রিভলবার চালাতে হয়। কেন? কারণ, শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। শত্রু কে? তার বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্ররা। হয়তো তারই ক্লাসমেট। এরা জাতিকে কি নেতৃত্ব উপহার দেবে?
দু–একটি ছাত্রসংগঠন ছাড়া অধিকাংশ ছাত্ররাজনীতি হলো অর্থ উপার্জনের ‘আলাদিনের চেরাগ’ আর ‘জাতীয় নেতা’ হওয়ার সিঁড়ি। তাই এসব ছাত্রসংগঠনের নেতা–কর্মীরা পড়াশোনার চেয়ে জাতীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ায় এবং অর্থ উপার্জন ও ক্ষমতা প্রদর্শনে বেশি ব্যস্ত থাকে। সে জন্য ছাত্র নেতাদের চার-পাঁচ বছরের কোর্স আট-নয় বছরে শেষ করতে দেখি।
কেউ কেউ শেষও করতে পারে না। গত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ের ছাত্রসংগঠনকে বাদ দিলেও আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি, লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ।
দুই. ছাত্রজীবন শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের ও কর্মজীবনের প্রস্তুতি নেওয়ার মোক্ষম সময়। এ সময়ই তারা তাদের শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করবে। তারা তাদের শিক্ষকদের গবেষণায় সম্পৃক্ত হবে।
যারা বহির্বিশ্বে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করবে, তারা সেই পথে অগ্রসরের জন্য সময় দেবে। অনেকে সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলবে, যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে ‘জেনারেশন জি’র উদ্ভাবনী শক্তি যেকোনো জাতিকে নতুন নতুন আবিষ্কার উপহার দিতে সক্ষম। বাংলাদেশ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে।
কিন্তু তাদের এই সম্ভাবনা যদি ছাত্ররাজনীতি আর রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ব্যবহৃত হয়, তাতে জাতি অপার সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হবে। তাই রাজনৈতিক নেতাদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে ভাবা উচিত। ছাত্রদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে মুক্তি দেওয়া উচিত। যাঁরা তা চান না, আমি বলব, তাঁরা ছাত্রদের শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারেননি।
তিন. যেসব ছাত্র ভবিষ্যতে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে আগ্রহী তারা তাদের স্বভাবজাত কারণে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এবং ছাত্রদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আন্দোলন করবে। তাদের অনেকে ওই সব আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে। এটা থেকে তারা নেতৃত্ব দেওয়া শিখবে।
তাই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রসংগঠন বা ছাত্রসংসদ থাকতে হবে। তবে সেটি কোনো দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্রসংগঠন বা ছাত্রসংসদ নয়।
অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তারা ভবিষ্যতে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়া শিখবে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, এ পর্যন্ত ৫৮ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ৩১ জনই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৪ জন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলেন। এ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের ষাটের অধিক সরকারপ্রধান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন।
কিন্তু তাঁদের কেউই ছাত্রজীবনে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে আসেননি। তাঁরা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হংকং, ইন্ডিয়াসহ অনেক বড় বড় দেশের সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন।
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশের শিক্ষা বিকাশের পথে একটি বড় অন্তরায়। আমাদের ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে যে আমাদের উচ্চশিক্ষার বিকাশের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতিকে গুটিয়ে নেবে।
ড. নুসরাতে আজীজ কানাডার আলগমা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক