নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে চারদিকে শোরগোল চলছে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে কয়েক মাস ধরে লেখালেখিও চলছে। নতুন শিক্ষাক্রম ভালো না মন্দ—এ নিয়ে ফয়সালা করার আগে সরকার এসব আলোচনা বা সমালোচনায় পাত্তা দিতে নারাজ। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অভিভাবকেরা যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে, তখন সরকার ‘শিক্ষার্থীদের কাঁধে’ নতুন শিক্ষাক্রম চাপিয়ে দেওয়ার সব বন্দোবস্ত করে ফেলেছে।
আমি যখন এই লেখা লিখছি (২৩ ডিসেম্বর), তখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ‘শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ’ চলছে। অথচ সপ্তাহ বাদে নতুন বছরে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে যাবে নতুন শিক্ষাক্রমের বই হাতে। চার-পাঁচ দিনের খণ্ডকালীন প্রশিক্ষণে শিক্ষকেরা এই শিক্ষাক্রমের জন্য ঠিক কতটা প্রস্তুত হতে পারলেন, সেটির মূল্যায়ন না বুঝে শিক্ষকদের কাঁধে বিশাল এই শিক্ষাক্রমের ভারোত্তলন করা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
কারণ, সরকার মনে করছে, এসব খণ্ডকালীন প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত শিক্ষকেরা ঠিকই সরকারের দেওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের ভাবগাম্ভীর্য বুঝতে সক্ষম হবে। কিন্তু বাস্তবে ঠিক কী ঘটছে, সেটি মাঠপর্যায়ের প্রশিক্ষণার্থীরা ভালো বলতে পারবেন।
অথচ একটি পরিকল্পিত শিক্ষাক্রমের এ ধরনের ‘প্রশিক্ষণ’ বছরজুড়েই হওয়ার কথা ছিল। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার মাসখানেক আগে ‘শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ’ আমাদের যে বার্তা দিচ্ছে, তাতে স্পষ্ট যে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সরকারের প্রস্তুতিতে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আর সেটিই আমাদের বড় শঙ্কার কারণ। একটি ধীরস্থির সিদ্ধান্তে যতটা সফলতা পাওয়া যায়, একটি তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তা সম্ভব হয়ে উঠে না। বরং এ ধরনের অকস্মাৎ ভাবনা ‘কয়েকটি প্রজন্মের’ মেধা বিকাশের অন্তরায় হতে পারে।
আমি আগেও বলেছি, আবার বলছি, নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধী আমি নই। বরং যুগোপযোগী পাঠ্যক্রমে আমার সমর্থন রয়েছে। তবে যে গতিতে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যাওয়া হচ্ছে, তা হিতে বিপরীত অবস্থান হতে বাধ্য—অনেকটাই নিশ্চিত করে বলতে পারি।
আমরা সত্যিই চাই, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি আমূল পরিবর্তন আসুক। আমরা চাই, যে শিক্ষা গ্রহণ করলে দেশ থেকে পালাতে হবে না, যে শিক্ষা গ্রহণ করলে দেশে পারদের মতো দ্রব্যমূল্য উঠবে না, যে শিক্ষা পেলে ‘সাদাটাকা’ ‘কালোটাকা’ শব্দ পত্রিকার শিরোনাম হবে না, আমরা এমনই একটি শিক্ষা চাই। চাই তেমন শিক্ষা, যা পেলে সমালোচনা করার জন্য জেলে যেতে হয় না। আমরা এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যা পেলে ন্যায্য ভোটের জন্য হাহাকার করতে হবে না, বাস-ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ মারা হবে না, রোগীর গাড়ি আটকিয়ে মন্ত্রীদের গাড়িবহর যাবে না।
পরীক্ষাভীতি ও মুখস্থনির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে এই নতুন শিক্ষাক্রমের স্লোগানের আগে ‘মুখস্থ’নির্ভরতার কথা বলে আমাদের ছেলেমেয়েদের কাঁধে ‘সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা’ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অথচ সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা কেন জনপ্রিয়তা পেল না, শিক্ষার্থীরা লাভবান হয়েছে নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—এই সংক্রান্ত জরিপের ফল আমরা অন্তত দেখতে পাইনি। কয়েকটি প্রজন্ম ওই সব শিক্ষা নিয়ে বড় হয়ে ‘আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’ বলতে শুনি, তখন আমাদের কোনো লজ্জাবোধই কাজ করে না।
কারণ, আমরা সব সময় নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করতে চাই না। ফলে ‘সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের’ ব্যর্থতা নিয়ে আবার আরেকটি ‘অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত’ গ্রহণ করে শিক্ষায় ব্যর্থতার সর্বশেষ পেরেক ঢুকিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করছি না।
কারণ, আমাদের বোধগম্যতা তখনই ফেরে, যখন আমাদের কিছু করার থাকে না। আমাদের হুঁশ তখনই আসে, যখন আমাদের হুঁশ নেওয়ার সময় থাকে না। এমন একটি পরিস্থিতিতে সারা দেশে বিভিন্ন স্তরের মানুষ যখন উৎকণ্ঠায়, তখন সরকার অজানা কারণে বিভ্রান্তি দূর করার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে জনসমর্থন পাওয়ার জন্য যেসব অনুষঙ্গ সরকারের দেখানো উচিত, সেটি দেখাতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। এমনকি যাঁরা নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কথা বলতে চান কিংবা সরকারের উদ্যোগকে সহযোগিতা করার জন্য ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করতে চান, তখন তাঁদের বিভিন্নভাবে বাধা দেওয়ার ঘটনা আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি।
অথচ নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যেসব কাঙ্ক্ষিত মূল্যবোধ অর্জিত হবে, তার মধ্যে চার নম্বরে রয়েছে পরমতসহিষ্ণুতা। রূপরেখার ২০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘ভিন্নমত বা ভিন্ন চিন্তাধারাকে সূক্ষ্ম চিন্তনদক্ষতা প্রয়োগের মাধ্যমে গ্রহণ বা বর্জনের স্বাধীনতা এবং এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহনশীলতা প্রদর্শন হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের অনুসারীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা প্রদর্শন হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা।’
পাঠ্যপুস্তকে হয়তো শিক্ষার্থীদের সহনশীলতার তাগিদ দেওয়ার কথা সরকার বলেছে, তবে বাস্তবে ঠিক কতটা পরমতসহিষ্ণুতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে গণতান্ত্রিক চর্চার বয়ান দিলেও তা যে আহত হচ্ছে, তা কি কেউ টের পাচ্ছে? নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা করার পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করার তথ্য গণমাধ্যমে বের হয়েছে। অন্যরাও কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। শিক্ষাক্রম নিয়ে মানববন্ধন-সমাবেশ করে প্রতিবাদকারীরা থাকছে শঙ্কিত।
এরই মধ্যে কিছু শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩ ডিসেম্বর সব ভয় উপেক্ষা করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে এই রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতে যখন আগ্রহী, ঠিক তখনই তাঁদের আলোচনার ভেন্যুই বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
কত বড় ভয়ানক আচরণ রে বাবা! যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই একটি উদারপন্থী কণ্ঠস্বর, সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই কীভাবে সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয় দিল, তা আমার বোধগম্য নয়। বরং নতুন শিক্ষাক্রম পাঠ করে যে ছেলেমেয়েরা পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় আসবেন, তাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ঠিক কতটা প্রস্তুত হচ্ছেন, তা দেখভালের জন্য শিক্ষাবিদদের ডেকে সম্মেলন করতে পারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গোলটেবিল আলোচনায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই শিক্ষাক্রমের ভালো-মন্দ দিকে নিয়ে আলোচনা করতে পারত, যাতে রাষ্ট্রের প্রতি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়বদ্ধতা রয়েছে, তা পূরণের সুযোগ মিলত।
কিন্তু সেটি না করে এই বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের ভাষায় কথা বলতে গিয়ে নিজেদের ছোট করে ফেলছে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে চলা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণ ‘ঈষৎ রাজনৈতিক’ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পড়েছে।
শিক্ষা নিয়ে যাঁদের পরামর্শ ও সুপারিশ দেওয়ার কথা, দেশের মেরুদণ্ড শক্তিশালী করতে নিজেদের ভূমিকা রাখার কথা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ই অসহনশীলতার পরিচয় দিয়েছে, যা মেনে নেওয়া কঠিন। প্রশ্ন হলো, তাহলে শিক্ষা নিয়ে কথা বলা যাবে না? শিক্ষা নিয়ে কথা বললে সরকার কী ভয় পাচ্ছে, নাকি সেখানেও রাজনৈতিক ইন্ধনের গন্ধ পাচ্ছে?
সবকিছুতে রাজনৈতিকীকরণ দৃষ্টির কারণে আমরা মানসিকতায় পিছিয়ে থাকছি। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়ার দরুন নিজেদের ভুলগুলো শোধরানোর সুযোগ পাচ্ছি না। অথচ যে মানুষগুলো শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন, শিক্ষাক্রম নিয়ে সরকারকে পরামর্শ দিতে চাচ্ছেন, তাতে যতটা রাজনীতির গন্ধ শোঁকা হচ্ছে, সেখান থেকে তার চেয়ে বেশি যদি নিজেদের ভুলভ্রান্তি সংশোধনের সুযোগ মিলত, তাহলে হয়তো একটি প্রজন্ম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে মুক্তি পেত।
আমি জোর গলায় বলতে চাই, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে উপযুক্ত পরিবেশ সরকার করতে পারেনি। আমরা যেসব বিষয় নিয়ে গত কয়েক দিন পত্রপত্রিকায় লিখেছি, তার সুরাহা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে দেখতে পাইনি। ‘পরিমার্জনের’ সুযোগ রেখে শিক্ষার্থীদের কাঁধে নতুন পাঠ্যপুস্তক হয়তো চাপিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু যে প্রজন্ম এসব পাঠ্যচর্চা করে এ দেশের দায়িত্ব কাঁধে নেবে, তাদের কিন্তু আমরা ‘পরিমার্জন’ করতে পারব না।
আমরা কেমন শিক্ষা নিয়ে বড় হয়েছি, তা দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষায় এলে বোঝা যায়। নিজেদের পড়াশোনা আর ভিনদেশিদের পড়াশোনার ঠিক কতটা ফারাক, বোধগম্যতায় কতটা অসহায়, তা প্রবাসী শিক্ষার্থীরা হাড়ে হাড়ে টের পান। অথচ এসব দেশ কিন্তু এখনো আমাদের দেশের মতো ‘স্মার্ট মুখস্থবিহীন’ পরীক্ষাহীন শিক্ষাক্রমে পা দেয়নি। তাহলে কি এসব দেশ আমাদের থেকে পিছিয়ে থাকছে? তারা কি ভবিষ্যতে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা নিতে আসবে?
যেকোনো ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হলো ছোটখাটো ভুল এড়িয়ে যাওয়া। দেখেও না দেখার ভান করা।
আমরা সত্যিই চাই, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি আমূল পরিবর্তন আসুক। আমরা চাই, যে শিক্ষা গ্রহণ করলে দেশ থেকে পালাতে হবে না, যে শিক্ষা গ্রহণ করলে দেশে পারদের মতো দ্রব্যমূল্য উঠবে না, যে শিক্ষা পেলে ‘সাদাটাকা’ ‘কালোটাকা’ শব্দ পত্রিকার শিরোনাম হবে না, আমরা এমনই একটি শিক্ষা চাই। চাই তেমন শিক্ষা, যা পেলে সমালোচনা করার জন্য জেলে যেতে হয় না। আমরা এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা চাই, যা পেলে ন্যায্য ভোটের জন্য হাহাকার করতে হবে না, বাস-ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ মারা হবে না, রোগীর গাড়ি আটকিয়ে মন্ত্রীদের গাড়িবহর যাবে না।
এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা পাওয়ার জন্য আমাদের আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ দিতে হবে। দলমত-নির্বিশেষে শিক্ষার জন্য শিক্ষাবিদদের একঘরে আনতে হবে। শিক্ষার বরাদ্দ অপ্রতুলতার অজুহাত দিয়ে ‘জাতির মেরুদণ্ড’ রক্ষা হয় না। বরং মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করতে শিক্ষার ব্যায়াম (আলোচনা-সমালোচনা) সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। আশা করি, সরকার শিক্ষা নিয়ে কথা বলার অধিকারটুকু হনন করবে না। শিক্ষায় অন্তত গণতন্ত্রের চর্চাটুকু থাকুক।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: nadim.ru@gmail.com