মতামত

মিয়ানমারের জান্তা কি ফিরিয়ে আনছে কুখ্যাত সেই ‘ফোর কাটস’

সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার পর মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে
ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে মুহূর্তে দেশটির দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য লড়াই চালাচ্ছে, সে মুহূর্তে সেখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধরত কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএনএলএ) এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের (পিডিএফএস) যৌথ বাহিনী ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করছে।

দেশটির জান্তা সরকারের দমন–পীড়ন ও চিরকাল ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টার ফল হিসেবে সাধারণ মানুষ ফুঁসে উঠেছে এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে পক্ষ ত্যাগের প্রবণতা বেড়েছে। এতে দেশটির সীমান্তবর্তী এলাকায় সশস্ত্র বিদ্রোহীরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকা এখন জান্তা সরকারের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এবং সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাল্টা হামলার ঘটনা বেড়ে গেছে।

এর ফলে জান্তা ক্রমবর্ধমানভাবে বিকারগ্রস্ত ও মরিয়া হয়ে উঠছে এবং তারা প্রচলিত যেসব সামরিক উপায়ে দমনাভিযান চালিয়ে থাকে, সেই কায়দায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর পীড়ন ও নির্যাতন বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বিমান ও ভূমি থেকে হামলা চালানোর পাশাপাশি জান্তা সেনারা তাদের সেই পুরোনো কুখ্যাত ‘চার পরিষেবা বিচ্ছিন্নকরণ কৌশল’ (ফোর কাটস স্ট্র্যাটেজি) দেশটির এমন সব এলাকায় অবলম্বন করা শুরু করেছে, যেখানে এর আগে কখনোই সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়নি। সে রকম একটি রাজ্য হলো মোন রাজ্য। এটি দেশটির চতুর্থ বৃহত্তম রাজ্য।

জান্তা সরকারের ‘চার পরিষেবা বিচ্ছিন্নকরণ কৌশল’ হলো কোনো সুনির্দিষ্ট এলাকায় খাদ্য, অর্থ, তথ্য ও জনবল নিয়োগ—এই চারটি সুবিধা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। ষাটের দশকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কারেন রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টি এবং কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের (এএনইউ) সঙ্গে লড়াই চালানোর সময় এই কৌশল অবলম্বন করেছিল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করার সময় তারা রাখাইন রাজ্যেও ঠিক একই কৌশল নিয়েছিল।

এখন মোন রাজ্যে এই কৌশল অবলম্বন করছে সেনাবাহিনী। প্রতিরোধ আন্দোলনের সশস্ত্র যোদ্ধাদের যাতে স্থানীয় জনগণ সহায়তা না দিতে পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।

মোন রাজ্যে কামানের গোলায় ঘরবাড়ি থেকে উপাসনালয়—সব ধরনের স্থাপনাকে সেনাবাহিনী বিধ্বস্ত করেছে। যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত বাসিন্দাদের কাছে যাতে কোনো খাদ্য ও পানি সরবরাহ পৌঁছাতে না পারে, তা নিশ্চিত করছে তারা।

ওই এলাকার মানুষের জমির ধান লুটে নেওয়ার জন্য তাদের এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানকার খাদ্যের গুদাম তথা মজুত এবং সরকারি ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নষ্ট করে ফেলছে।

মোন রাজ্যের অবস্থা এখন খুবই সঙিন। সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর থেকেই পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস এবং কারেন আর্মড ফোর্সেস যৌথভাবে এই রাজ্যের কয়েকটি এলাকায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। এখানে জান্তা বাহিনী তাদের বেশ কটি অবস্থান হারিয়েছে। ফলে সেনাবাহিনী এখন বিমান থেকে নির্বিচার বেসামরিক লোকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। সেনা হামলা থেকে বাঁচতে সেখানকার প্রায় ৩০ হাজার বাসিন্দা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

নিউ মোন স্টেট পার্টির (এনএমএসপি) একজন সাবেক সদস্য ও কাইকমায়াউ শহরতলির বাসিন্দা মানবাধিকার সংস্থা হারফোমকে বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী আমাদের বিরুদ্ধে “ফোর কাটস ক্যাম্পেইন” ব্যবহার করছে। এটি একটি ভয়ানক ব্যাপার।’

হারফোমের একটি প্রামাণ্য নথি থেকে জানা যাচ্ছে, নভেম্বরের তিন সপ্তাহে জান্তা এবং বিপ্লবী সেনাদের লড়াই বেড়ে যায়। সেখানে নির্বিচার ধরপাকড় করার পাশাপাশি সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে পুরো এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট লাইনের পাশাপাশি ওয়াই–ফাই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

এ অবস্থায় বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোকে নিরাপত্তা, খাদ্য, আশ্রয় ও ওষুধ পেতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছোটাছুটি করে বেড়াতে হচ্ছে। গত ১৭ নভেম্বর থেকে পুরো মোন রাজ্যটি একটি ভুতুড়ে এলাকায় পরিণত হয়েছে। ফোন, ইন্টারনেট, ওয়াই–ফাই না থাকার কারণে বিপদগ্রস্ত লোকজন বাইরের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না।

যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় অনেক গ্রাম অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। সেখানে ত্রাণ পৌঁছানোও অসম্ভব করে তুলেছে জান্তা বাহিনী।

তবে আশার কথা হলো, মিয়ানমারের মানুষ এক হতে শুরু করেছে।

  • নাই আউ মোন নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস ডকুমেন্টেশন-বার্মার (এনডি-বার্মা) ব্যবস্থাপনা বোর্ডের একজন সদস্য এবং

  • ম্যাগি কাদরানি থাই-মিয়ানমার সীমান্তে লিঙ্গসমতার ওপর নজর রাখা বিভিন্ন স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও গবেষণা প্রকল্পে কাজ করেছেন

  • এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত