বাংলাদেশে বেকারত্ব এখন মূল্যস্ফীতির পর সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই অচলাবস্থা ভেঙে দেওয়ার জন্য বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে দ্রুত নজর দিতে হবে। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ দুই বছরে পাঁচ লাখ জনবল সরকারি চাকরিতে নিয়োগের কথা বলেছেন। অনেকেই তা রাজনৈতিক কথা হিসেবে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সংজ্ঞা অনুযায়ী, বেকার জনগোষ্ঠী মূলত তাঁরাই, যাঁরা গত ৭ দিনে কমপক্ষে ১ ঘণ্টাও কোনো কাজ করেননি, তবে ৭ দিন কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং ৩০ দিনে বেতন বা মুনাফার বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজ খুঁজেছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গাইডলাইন অনুযায়ী, যিনি কাজ করছেন অথচ প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না (সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করছেন না) তাঁকে আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়।
বিবিএসের আগস্টে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, দেশে মোট বেকার ২৬ লাখ ৪০ হাজার। এই তথ্য আসলে বাস্তবতাবর্জিত। বিডিজবস ৩০ বছরের নিচে ২৫ লাখ তরুণের মধ্যে একটা সমীক্ষা করেছে। সেই সমীক্ষা বলছে যে দেশের ৩০ বছর বয়সের নিচে ৫১ শতাংশ শিক্ষিত তরুণ এখন বেকার। টিআইবির আগের তথ্যমতে, যা ছিল ৪৭ শতাংশ।
এই অবস্থার কি সমাধান সম্ভব? সম্ভব হলে কীভাবে? আর বাধাগুলোই–বা কী? এই সমস্যার সমাধানকে দুভাবে দেখা যায়—স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি।
১. শূন্য সরকারি পদে নিয়োগ নাকি খরচ কমানো? কালের কণ্ঠ ৯ অক্টোবর ২০২৪–এর প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে সরকারি চাকরিতে পদ খালি আছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৩৩৩টি। যেসব কর্মকর্তা ঠিকমতো কাজ করছেন না ও দুর্নীতিগ্রস্ত, তাঁদের ছাঁটাই করলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। উপদেষ্টার কথা রাখা কিন্তু শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক। সরকারের ব্যয় সংকোচন করতে হলে এই বিপুল নিয়োগদান কঠিন। আগের সরকারের সময়ও সরকারি খাতে বেতন–ভাতা বাবদ ব্যয় ২০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাবনা ছিল। আগে তো টাকা ছাপিয়ে বেতনও দেওয়া হতো। এখন কীভাবে সম্ভব হবে? এখন উপদেষ্টা তাঁর কথা রাখতে হলে সরকারি কর্মচারীদের সুবিধা কমিয়ে এই নিয়োগ বাস্তবায়ন করলে কিছুটা হলেও লাভ হতো। কিন্তু এই পরিমাণ নিয়োগও আসলে প্রয়োজনের তুলনাতে যথেষ্ট নয়।
২. অবৈধ বিদেশি বিতাড়ন: দেশে কতজন বিদেশি অবৈধভাবে কাজ করছেন, তার সঠিক হিসাব নেই। ২০২০ সালে স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) তথ্যমতে, এই সংখ্যা ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৭৯। বাংলা ট্রিবিউন ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০–এর তথ্যমতে, দেশে থাকা মোট বিদেশি ৩০ লাখের মতো (রোহিঙ্গাসহ)। কিন্তু অবৈধভাবে কাজ করছেন প্রায় ১০ লাখ বিদেশি। উন্নয়নমূলক কাজ বাড়ার ফলে বিদেশিদের আগমনও বেড়েছে এই তিন বছরে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট সামির সাত্তারের মতে, প্রতিবছর বিদেশিরা নিয়ে যাচ্ছেন ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো (ইত্তেফাক ৯ জুলাই ২০২৩)। এই অবৈধ বিদেশিদের বিতাড়ন করলে অন্তত আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়ে যায়। দেশ বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় করতে পারে। অবশ্য এর আগে প্রয়োজন নিজেরা তাদের স্থান নেওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করা।
৩. বিদেশে কর্মী ও শিক্ষার্থী পাঠানো এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৫৫ লাখ ১৩ হাজার ৪৬০। ২০২২ সালে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে কর্মী বিদেশে গেছেন ১১ লাখ ৩৬ হাজার। গড়ে এখন প্রতিবছর ১২ লাখ মানুষ বিদেশে চাকরি করতে যান। এসব কর্মীদের বিদেশ পাঠানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বেসিক ইংলিশ জ্ঞান দেওয়া, কীভাবে চলাফেরা করতে হবে শিক্ষা দিলে দেশেরই লাভ।
আমাদের আর একটা দিক চালু করা উচিত, বিদেশে ‘হোয়াইট কলার’ পাঠানো। পাশের দেশ ভারত এই ম্যানেজমেন্ট শ্রেণিতে লোক পাঠিয়ে অনেক বেশি রেমিট্যান্স পাচ্ছে। আমাদের এই খাত শুরু করার সময় হয়ে গেছে।
এ ছাড়া ইউনেসকোর তথ্যমতে, প্রতিবছর বিদেশ যান ৮০ থেকে ৯০ হাজার শিক্ষার্থী (বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ১৫ এপ্রিল ২০২২)। তাঁদের বেশির ভাগই ফিরে আসতে চান না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস এখনো সেই আগের ধাঁচের রয়ে গেছে। যাঁরা শিক্ষার্থী কোটায় বিদেশ যাবেন, তাঁদের জন্য রিসার্চ মেথডোলজি বিষয়ের সঙ্গে থিসিস ও ইন্টার্নি দুটিতেই স্নাতক লেভেলে বাধ্যতামূলক করতে হবে। আর সবকিছুকে দালালমুক্ত করে গাইড দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের পাশের দেশের থেকে আমাদের প্লেনের খরচ প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। আমাদের প্লেনের ভাড়া কমাতে হবে।
১. বেসরকারি খাতকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো, আইন প্রণয়ন ও আবার শিক্ষাব্যবস্থা: দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি খাতের কোম্পানির ব্যবসার অবস্থা খারাপ। তাদের ব্যবসার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সরকারেরই দায়িত্ব। ব্যবসা সহজীকরণ র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ছিল ১৬৮, যা একেবারে নিচের দিকে। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। বেসরকারি খাত থেকে একজন উপদেষ্টা নিয়োগ খুব দরকার ছিল, যা এই অচলাবস্থা দূর করতে সহায়ক হতো।
এদিকে সরকারি চাকরিতে যে নিশ্চয়তা আছে, সেখানে বেসরকারি চাকরিতে ন্যূনতম আইনও নেই। এই জন্য সংস্কার কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি।
বেসরকারি খাতের একটা বড় সমস্যা তারা উপযুক্ত প্রার্থী পাচ্ছে না। এই অবস্থা কাটানোর জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্নাতক সিলেবাসে ইন্ডাস্ট্রি সংযুক্তকরণ আর ইন্টার্নশিপ যুক্ত করা প্রয়োজন। চালু করা দরকার যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মৌলিক সফট স্কিল তৈরি করতে হবে। চাকরিপ্রার্থীরাও বিসিএসের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না করে আইবিএ ভর্তি প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে তাঁদের অনেক দুর্বলতা দূর হয়ে যায়।
২. উদ্যোক্তা তৈরি করা, নিজেদের স্বাবলম্বী করা: অনেকে সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে ৩০ বছরের বয়স সীমা পার করে ফেলছেন। অনেকে বেসরকারি চাকরি পাচ্ছেন না বা ছাঁটাই হচ্ছেন। তাঁদের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। দেশ শিক্ষিত বেকার তৈরির ক্ষেত্রে এশিয়া প্যাসেফিক অঞ্চলের ২৮ দেশের মধ্যে ২য়। আবার ব্যবসাবান্ধব পরিবেশেরও তলানিতে থাকা দেশ আমরা। আশার কথা, দেশের শিক্ষিত ব্যক্তিরা কৃষিতে গুরুত্ব দিয়ে কিছুটা বেকারত্ব কমিয়েছেন। আবার নিরাশার কথা, অলিগার্করা সিন্ডিকেট করে কৃষিসহ সব নতুন নতুন ব্যবসার উদ্যোগ খেয়ে ফেলার চেষ্টায় আছে। এই সিন্ডিকেট গুঁড়িয়ে দিয়ে সবার জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
আমাদের দেশ পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এই নির্ভরতা কাটিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার লক্ষ্য নিতে হবে। বিদেশি কোম্পানিগুলোর ডেটা সেন্টার নিয়ে আসা, দেশকে বিকেন্দ্রীকরণ করে সব বিভাগে অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিতে হবে। ঢাকাকে মুক্ত করলে আপনাআপনি অনেক কাজের সূচনা দেখা যাবে।
এসব দেখে মনে হতে পারে যে দেশের বেকার সমস্যা সমাধান তো আমাদের হাতের মুঠোয়। বাস্তবতা এত সহজ নয়। আইএলওর সংজ্ঞা মতে, দেশে ছদ্মবেকারের সংখ্যা আরও ৬৬ লাখ। দেশে কর্মক্ষম কিন্তু একেবারেই কোনো কাজে যুক্ত নন, এমন মানুষ আছে ৪ কোটি ৭৩ লাখ ২০ হাজার জন (ডয়েসে ভেলে ২৭ আগস্ট ২০২৩)।
এত সব উপাত্ত দেখাচ্ছে আমাদের কাঠামোই ঠিক নেই। এখানে স্বল্পমেয়াদি সমাধান কিছুটা স্বস্তি দিলেও ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে পুরো ব্যবস্থাই নতুনভাবে ঢেলে সাজানো লাগবে। তা না হলে আমাদের বেকার সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
উপদেষ্টা তাঁর কথা রাখার চেষ্টা করতেই পারেন। কিন্তু তাঁর পথ আটকে দেবে পুরোনো পাপের বোঝা-আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। বেসরকারি খাতকে যদি শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় না করানো যায়, তাহলে এই সমাধান কোনোটাই টেকসই হবে না। এখন আর জোড়াতালি দিয়ে সমাধান চাই না।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
ই–মেইল: contact@subail.com