গত বছর কুড়িগ্রামের নদীতীরবর্তী মানুষকে নিয়ে নদীবিষয়ক সংলাপের আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং রিভারাইন পিপল যৌথভাবে এ আয়োজন করেছিল। এ আয়োজনে বিশেষ অতিথিদের মধ্যে একজন ছিলেন গণকমিটির সাবেক সভাপতি নাহিদ হাসান।
তিনি কুড়িগ্রামের উলিপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বুড়িতিস্তা নদী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘পৃথিবীর দীর্ঘতম পুকুরের নাম বুড়িতিস্তা। নদীটির উৎসমুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটাকে এখন আর নদী বলা চলে না। এটাকে পুকুর বানানো হয়েছে।’
বুড়িতিস্তা নদী কুড়িগ্রামের উলিপুরে থেতরাইয়ে ইংরেজি বর্ণ ‘ভি’-এর মতো হয়ে প্রবাহিত হতো। তিস্তা নদী ‘ভি’-এর নিচের অংশ ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাওয়ায় বুড়িতিস্তা দুই ভাগ হয়ে যায়। উজানের অংশ তিস্তার উপনদী এবং ভাটির বুড়িতিস্তা নদী তিস্তার শাখা ও ব্রহ্মপুত্রের উপনদীতে পরিণত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাটির বুড়িতিস্তার উৎসমুখ বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নদীটি পানি উন্নয়ন বোর্ড খনন করে তার মাটিগুলো দুপারে পুকুরের পাড় বাঁধার মতো ফেলেছে।
আর সম্পূর্ণ নদীটি কল্পনায় নিলে মনে হবে ১৮ কিলোমিটার একটি পুকুর। যে পুকুরের এক দিক উন্মুক্ত, অপর তিন দিক বন্ধ। এ কারণে নাহিদ হাসান উলিপুরের বুড়িতিস্তা নদীকে পৃথিবীর দীর্ঘতম পুকুর বলে অভিহিত করেছেন। উল্লেখ্য, উজানের বুড়িতিস্তা (চাকিরপশার) নদীতে আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। নদী ও জনজীবনে এ সড়ক গলার কাঁটা হয়ে আছে।
এবার আসি সরুতম নদীর কথায়। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর পৌরসভা দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী স্বরমঙলা। স্থানীয় অনেকেই এ নদীকে সর্বমঙলা বলেও অভিহিত করেন। তাঁদের ভাষ্য নদীটি সবার মঙ্গল করে বলে এর নাম সর্বমঙলা। স্বরমঙলা কিংবা সর্বমঙলা নাম যা-ই হোক না কেন, নদীটি মানুষের জন্য খুবই উপকারী ছিল।
পৃথিবীর দীর্ঘতম পুকুর আর সরুতম নদী চোখের সামনে হয়েছে। সাধারণ মানুষও যদি নিজেদের দায়িত্বটুকু পালন করতেন, তাহলেও এমন ভয়াবহ রূপ দেখতে হতো না। আমরা সবাই মিলেই যেন নদীর শত্রুতে পরিণত হয়েছি। আর এর মাধ্যমে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের দেশে নদীর পরিচর্যার নামে নদীর কত যে ভয়াবহ সর্বনাশ করা হয়েছে, তার একটি দৃষ্টান্ত কুড়িগ্রামের বুড়িতিস্তা নদী। উন্নয়নের নামে নদী মেরে ফেলার একটি দৃষ্টান্ত স্বরমঙলা। কিন্তু এ রকম ঘটনা অহরহই চোখে পড়বে। এখন তো পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিএডিসি, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নদীকে খাল নামে ডাকার একটি রেওয়াজ চালু করেছে। স্বরমঙলা নদীর দুই কিলোমিটার ভাটিতে আছে বাগডোকরা নদী।
বিএডিসি এ নদী খনন করে নাম দিয়েছে বাকডোকরা খাল। স্থানীয় লোকজন কোনো দিন এ নদীকে খাল নামে শোনেননি। কিন্তু তারা সেখানে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে। পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো এটিকে খাল নামে চিনবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সৈয়দপুরের ভাটিতে পার্বতীপুর উপজেলার সোনারবন্দ নদীকে খাল নাম দিয়ে খনন করেছে।
বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা ঐতিহ্যবাহী নদী নলেয়াকে নলেয়া খাল উল্লেখ করছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর নদীর বুকে খাল-পুকুর খনন করছে। রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার বাইশাডারা খননের কাজ করেছে এ বিভাগ।
উপকারী গাছের যেমন বাকল থাকে না, তেমনি এ নদীর অস্তিত্ব খেতে বসেছে মনুষ্যকুল। সৈয়দপুর বাস টার্মিনালের পাশে এ নদীর ওপর ঢাকা-সৈয়দপুর মহাসড়ক। মহাসড়কের ওপর সেতুর রেলিং চোখে পড়বে। সেতুর রেলিং ঘেঁষে আছে মানুষের ব্যক্তিগত ঘর। মহাসড়কের কয়েক কিলোমিটার উজানের স্বরমঙলা অনেক স্থানে ভালো স্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছে। আবার কোথাও কোথাও এর অবস্থা ওষ্ঠাগত। একই বাস্তবতা ভাটিতেও। রংপুর জেলার তারাগঞ্জ উপজেলায় এ নদীর স্বাস্থ্য টিকে থাকলেও পানির প্রবাহ কমে গেছে। তলদেশ যেমন ভরাট হয়েছে, তেমনি পানির উৎসগুলো বন্ধপ্রায়।
গত বছর সৈয়দপুর বাস টার্মিনালের ভাটিতে স্বরমঙলা নদী দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে ভদ্রগোছের এক ব্যক্তির বাড়ি। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, স্বরমঙলা নদীটি ওখানে কোন স্থানে আছে বা ছিল। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, সেখানে কোনো দিন কোনো নদী ছিল না। তাঁর কাছেই জানলাম সামনের বাড়িটি তাঁর নিজের। তাঁর কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে আরও একটু সামনে এগিয়ে যাই। দেখলাম, প্রায় দুই থেকে আড়াই ফুট পাকা করে পাড় বাঁধা একটি পানির প্রবাহ।
ওই বাড়ির মালিক খুব গর্বের সঙ্গে বলছিলেন তিনি পানিনিষ্কাশনের জন্য নাকি দয়া করে একটি ক্যানেল তৈরি করে দিয়েছেন। কয়েক শ ফুট প্রস্থের একটি নদী যে আড়াই ফুট প্রস্থের নদীতে পরিণত করেছেন, সে কথা তিনি স্বীকার করতে নারাজ। তাঁকে যখন বললাম, আমি রংপুর থেকে জেনেই ওই নদী দেখতে এসেছি, তখন তিনি কিছুটা স্বীকার করলেন স্বরমঙলা নামের একটি নদী ওখানে পাশে যেন কোথায় ছিল। পৃথিবীতে বোধ করি এর চেয়ে আর সরু কোনো নদী নেই।
পৃথিবীর দীর্ঘতম পুকুর আর সরুতম নদী চোখের সামনে হয়েছে। সাধারণ মানুষও যদি নিজেদের দায়িত্বটুকু পালন করতেন, তাহলেও এমন ভয়াবহ রূপ দেখতে হতো না। আমরা সবাই মিলেই যেন নদীর শত্রুতে পরিণত হয়েছি। আর এর মাধ্যমে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছি।
কয় দিন আগে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় শাহিনুর রহমান নামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বলছিলেন ‘আমরা যদি ১৯৪০ সালের সিএস নকশা অনুযায়ী নদীগুলো উদ্ধার করতে পারতাম, তাহলে বিশ্বের অন্যতম সুন্দর একটি দেশ হতো বাংলাদেশ। সরকার চাইলে সেটি সম্ভব।’ ওই শিক্ষকের মতো করে সরকার ভাবুক। দীর্ঘতম পুকুর আর সরুতম নদীর কলঙ্ক থেকে দেশের মুক্তি ঘটুক।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক wadudtuhin@gmail.com