‘অনেক দেশেই এখন ছাদ সাদা করার পরিকল্পনায় মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।’
‘অনেক দেশেই এখন ছাদ সাদা করার পরিকল্পনায় মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।’

বাড়ির ছাদে সাদা রং করে তাপ কমাবেন যেভাবে

ট্র্যাফিক পুলিশের ছাতার রং সাদা হলে কড়া রোদের মধ্যে যে সুবিধা পাওয়া যায় বা গরমে সাদা রঙের পোশাক পরলে গরম যতটা সহনশীল হয়, সেই একই রকম চিন্তা থেকে যদি বাড়ির ছাদে সাদা রং করে দেওয়া যায়, তাহলে একই সুবিধা পাওয়া সম্ভব। ছাদে সাদা রং করা একটি সাধারণ বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা। সাদা রং তাপ কম শোষণ করে এবং তাপ প্রতিফলিত হয়ে ফেরত চলে যায়।

এটি একটি অপেক্ষাকৃত নতুন পদ্ধতি, যা অনুসরণ করে বিভিন্ন দেশ উপকার পাচ্ছে বলে খবরে পড়েছি। ইংরেজিতে বলে হোয়াইট রুফিং, অর্থাৎ ছাদে সাদা রং করে দেওয়া। বাসাবাড়ি ও অফিস স্থাপনার ছাদে সাদা রং করে দেখা গেছে, ভবনের ভেতরের আবহাওয়া ঠান্ডাতর হয়।

বলা হচ্ছে, এ কাজ করলে ভবনের বিদ্যুৎ খরচ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে যায়। আগে খুব সাধারণ রং দেওয়া হতো; এখন নানা রকমের উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে আলো ও তাপ প্রতিফলিত করে—এমন কিছু পদার্থও প্রয়োগ করা হয়। তাতে ফল মিলেছে। ভেতরটা অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা থাকছে।

আমাদের ঢাকাসহ দেশের সব শহরই গ্রীষ্মকালে আবহাওয়া জ্বলে ওঠে। এ বছর একটু বেশিই দেখা যাচ্ছে। এই ঋতুতে তাপমাত্রা বাড়বেই। এখন যে বেশি বেশি জ্বলে উঠছে, তার কারণগুলো আমরা জানি। সেই কারণগুলো নির্ণয় করে সমাধান করতে পারলে তো খুব ভালো হয়, কিন্তু না করতে পারলে আমাদের ছোটবেলায় পড়া পদার্থবিদ্যা মাথায় রেখে সাধারণ একটি কাজ করলেই তাপ-সমস্যার সমাধান আমরা করতে পারি।

হোয়াইট রুফিং খুব সহজ কাজ। সামান্য কিছু অর্থ খরচ হবে, তবে তার চেয়ে বেশি অর্থ বেঁচে যাবে। আমাদের শহরগুলোয় বাড়িগুলোর ছাদের রং সাধারণত কালো অথবা ধূসর বা গাঢ় কোনো রং হয়। এমন রঙের ছাদ থাকলে তো সৌররশ্মি অনেক বেশি শোষণ করে এবং ভবনের ভেতর তাপ চড়ে যায় এবং আমরা হাঁসফাঁস করি। আমাদের শহরগুলো এমন লাখ লাখ ভবন-অফিস নিয়ে একেকটা তাপের দ্বীপ হয়ে উঠেছে।

সাদা ছাদ সূর্যের উত্তাপকে প্রতিফলিত করে আবার ওপরের দিকে ফিরিয়ে দেয়, গরমের তীব্রতা কমিয়ে দেয়, তাপ শোষণ রোধ করে এবং বাড়ির ভেতরকে ঠান্ডা রাখে। হোয়াইট রুফিং পদ্ধতি অনুসরণ করলে ভবনগুলোর এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেমগুলোর ওপর নির্ভরতাও কমানো যায়।

ছাদ সাদা করার প্রভাব নিয়ে সহজেই পরীক্ষা চালানো যায়। পাশাপাশি দুটি ভবনে পরীক্ষা চালালেই বোঝা যাবে। একটি ভবনের ছাদে সাদা রং করে তার ভেতরের তাপমাত্রা পরিমাপ এবং পাশের ভবনের ভেতরের তাপমাত্রা মাপলেই পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা।

সহজ এ বিষয় শিখতে চাইলে বিশ্বের কয়েকটি শহরের অভিজ্ঞতা আলোচনা করলেই বোঝা যাবে। অনেক দেশেই এখন ছাদ সাদা করার পরিকল্পনায় মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। ভারতের মুম্বাই ও চেন্নাই এ কাজে বেশ এগিয়ে থেকে ঘরের তাপমাত্রা কমিয়ে ভবনের বিদ্যুৎ ব্যবহার হ্রাস করতে পেরেছে। একইভাবে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ও মেলবোর্নে তাপ প্রতিরোধ করতে এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। মেক্সিকো, ফিলিপাইন, গ্রিস ও স্পেন এ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে ভালো ফল পেয়েছে।

সাদা ছাদ আসলেই উপকারী। স্থাপনাগুলো থেকে তাপ কমানোর একটি বাস্তবমুখী উপায়, যা খুব কম খরচে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করতে পারে। তবে হোয়াইট রুফিং নিয়ে গভীর প্রয়াস প্রয়োজন, যা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য একটি সাশ্রয়ী ও বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে।

ছাদ সাদা করার প্রকল্পের একটি বড় উদাহরণ হলো নিউইয়র্ক শহরের ‘কুল রুফস প্রোগ্রাম’। ২০০৯ সালে শুরু হয়েছিল এই প্রকল্প, যখন ভবনমালিকদের অবকাঠামো সাহায্য এবং রং বিতরণ করে উৎসাহিত করা হয়েছিল। ফলে ওই শহরের অনেক ভবন সাদা ছাদে পরিণত হয়েছে, যা বিদ্যুৎ ব্যয় ও কার্বন নিঃসরণ কমিয়েছে।

এই তথ্যগুলো ইন্টারনেটে খুঁজলেই পাওয়া যায়। প্রয়োজনে কর্মকর্তারা সেখানে গিয়েও দেখে আসতে পারেন।

বাংলাদেশে হোয়াইট রুফিং পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। যদি এই পরীক্ষা সার্থক হয়, তাহলে এই পদ্ধতি বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক এড়ানোর পথে একটি বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।

‘হোয়াইট রুফিং খুব সহজ কাজ। সামান্য কিছু অর্থ খরচ হবে, তবে তার চেয়ে বেশি অর্থ বেঁচে যাবে।’

কাজ শুরু করা যেতে পারে রং কোম্পানিগুলোর পরামর্শ নিয়ে। আমি জানার জন্য তাদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং তারা এই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ের সঙ্গে একমত। তারা ইতিমধ্যেই কাচের গায়ে প্রলেপ দেওয়া যায়—এমন একটি স্বচ্ছ রঙের পদার্থ নিয়ে কাজ করছে। তারপর ভবনমালিক, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার, সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় একসঙ্গে উদ্যোগ নিয়ে একটি জাতীয় কৌশলপত্র তৈরি করে তা বাস্তবায়ন শুরু করতে পারে।

একই সঙ্গে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির অভিযান এবং স্কুলে স্কুলে শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম চালু করতে হবে; কারণ, সব কাজ সরকার করে দিতে পারবে না। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোয় সাদা ছাদের প্রচলন বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

তবে মনে রাখা প্রয়োজন, শুধু ছাদ সাদা করলেই যে আমাদের তাপমাত্রার সমস্যা দূর হয়ে যাবে, তা নয়; আমরা যদি নিরলসভাবে নগরায়ণ করেই চলি, শহুরে বনায়ন না করি, সবুজ স্থানগুলোয় স্থাপনা তৈরি করে ফেলি, জলাশয় দখল করে সব শেষ করে ফেলি, বায়ুকে দূষিত করতেই থাকি, তাহলে সাদা ছাদের উপকার খুব সামান্যই পাওয়া যাবে।

সাদা ছাদ আসলেই উপকারী। স্থাপনাগুলো থেকে তাপ কমানোর একটি বাস্তবমুখী উপায়, যা খুব কম খরচে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করতে পারে। তবে হোয়াইট রুফিং নিয়ে গভীর প্রয়াস প্রয়োজন, যা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য একটি সাশ্রয়ী ও বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে।

আমাদের দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক বিরূপ প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়েছে। ছাদ সাদা করার এই বিজ্ঞানসম্মত উপায় কর্তৃপক্ষ আশা করি আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করে দেখবে।

  • ইকরাম কবীর কথাসাহিত্যিক