আশঙ্কা ও অনাস্থার উপাত্ত সুরক্ষা আইন

বর্তমান পৃথিবী ডিজিটাল। ভবিষ্যতের জ্বালানি ডেটা। এই ডিজিটাল জগতের ডেটা বা উপাত্তের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষা করা এ সময়ের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আঙ্কটাডের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৩৭টি দেশ ইতিমধ্যে এ–সম্পর্কিত কোনো না কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিছুটা দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ১৩৮তম দেশ হিসেবে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করেছে। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা সরকারের যে পর্যায় থেকেই আসুক না কেন, ভবিষ্যতের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে এটি যে ‘স্মার্ট থিঙ্কিং’, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যাঁরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, তাঁদের ইতিমধ্যে অনুধাবন করতে পারার কথা যে উপাত্ত সুরক্ষার আইন না থাকলে কিছুদিনের মধ্যেই ব্যবসা পরিচালনা করা কার্যত অসম্ভব হয়ে যাবে।

তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ তথাকথিত উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও এ–সংশ্লিষ্ট গ্রহণযোগ্য আইন বা সমাধান তৈরি করতে হিমশিম খাচ্ছে। সবারই ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা। বর্তমান ডিজিটাল ব্যবস্থা একটি গ্লোবাল বা বৈশ্বিক ধারণা, এটি দেশ-কাল-জাতির সীমানা ভেঙে দিয়ে সবাইকে একই ব্যবস্থায় সংযুক্ত করেছে। অন্যদিকে, স্থানীয়করণ বা লোকালাইজেশনের ধারণাগুলো লোকাল বা স্থানিক ধারণা। বৈশ্বিক ধারণার ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনায়, লোকাল বা দেশীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ ধারণা বাস্তবায়ন করতে গিয়েই যত সমস্যা।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বড় বড় ডিজিটাল সার্ভিস, যেমন ইউটিউব, ফেসবুক, অ্যামাজন ইত্যাদি ব্যবহারকারীদের কম সময়ে সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে তাদের সার্ভার স্থাপন করে, একই ডেটার কপি বিভিন্ন জায়গায় রাখে তারা। এটি ডেটার ব্যাকআপ হিসেবেও কাজ করে। কিন্তু এখন তাদের যদি নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া হয়, না, এ দেশের সীমানার বাইরে ডেটা রাখা যাবে না, তখন তারা চাইলেও সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গায় ডেটা সংরক্ষণ করে রাখতে পারবে না। আইনি নির্দেশনা মেনে নির্দিষ্ট দেশের সীমানায় তাদের ডেটা রাখতে হবে। আবার অন্যদিকে, তাদের যদি যেখানে খুশি সেখানে ডেটা রাখার স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তাহলে যে দেশে ডেটা রাখা হলো, সে দেশের কর্তৃপক্ষ আইনিবলে অন্য দেশের নাগরিকের ডেটা নিয়ে যা খুশি তা–ই করতে পারবে। অতএব ব্যাপারগুলো স্বাভাবিকভাবেই উভয়সংকটের সৃষ্টি করেছে।

এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্যোগে করা জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর) সারা বিশ্বে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ভিন্ন ভিন্ন দেশ নিজেদের মতো করে পরিবর্তন–পরিমার্জন করে উপাত্ত সুরক্ষায় ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। অতএব অন্যান্য দেশ থেকে কপি পেস্ট করে নিয়ে এসে একটি দেশের জন্য উপাত্ত সুরক্ষার নিয়ম নীতিমালা করে ফেলা যায় না। প্রয়োজন হয় সেই দেশের প্রেক্ষাপটে সমস্ত কারিগরি দিক, অর্থনৈতিক দিক বিচার–বিশ্লেষণের; তুলনামূলক লাভ–ক্ষতির অঙ্কটা একেবারে খাতা-কলম নিয়ে বসে নির্ধারণ করতে হয়।

আমাদের দেশের বেশির ভাগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র বা মাঝারি ধরনের। একদিকে আমরা ডিজিটাল রূপান্তরের (ট্রান্সফরমেশন) কথা বলছি, অন্যদিকে আইন করে ডিজিটাল উপাত্ত ব্যবস্থাপনার জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ একটি তালিকা ধরিয়ে দিচ্ছি। এ অবস্থায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এই আইন মেনে ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে যাওয়া আদৌ সম্ভব কি না বা কী মাত্রায় সম্ভব, সেটি বিবেচনার দাবি রাখে। সবার জন্য একই সময়ে একই শর্ত না দিয়ে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি না, সেটিও চিন্তা করা যেতে পারে।

এবার আরেকটি কাল্পনিক উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক। বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলোকে যদি বলা হয়, যেহেতু ফ্লাইটের বেশির ভাগ যাত্রীই বাংলাদেশের, সেহেতু বাংলাদেশি যাত্রী পরিবহনকারী উড়োজাহাজকে সব সময় বাংলাদেশের বিমানবন্দরেই অবস্থান করতে হবে, এখান থেকেই অন্য দেশে যাবে, এখানেই আবার ফিরে আসবে। উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে নিরাপত্তাব্যবস্থা সব বাংলাদেশেই সম্পন্ন হবে। যেহেতু বাংলাদেশের যাত্রী পরিবহন করে তারা লাভবান হচ্ছে, বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট দিক বিবেচনা করে এটি বলা যৌক্তিক মনে হতেই পারে। কিন্তু  তার আগে তো উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা থেকে শুরু করে জ্বালানি ও যন্ত্রাংশের সহজলভ্যতা—এগুলো বাংলাদেশকেই নিশ্চিত করতে হবে।

শুধু তা–ই নয়, এমনও হতে পারে যে ইউরোপিয়ান একটা দেশের দেওয়া একই শর্ত এয়ারলাইনসগুলো হয়তো মেনে নিতে সমস্যা হবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশের দেওয়া শর্তও তারা মেনে নেবে। যে শর্ত ইউরোপে মেনে চলা সম্ভব, সে একই শর্ত বাংলাদেশে মেনে চলা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক না–ও হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে শর্তের বেড়াজালে পড়ে এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বা সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া কিংবা নতুন কোনো এয়ারলাইনসের ফ্লাইট পরিচালনার আগ্রহ না থাকা—অবাক হওয়ার মতো কিছু হবে না।

ডেটা বা উপাত্তের ক্ষেত্রেও এ ধরনের দিকগুলো বিবেচ্য। উপাত্ত সুরক্ষার ক্ষেত্রে যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন ধরনের শর্ত বা বাধ্যবাধকতার কথা চিন্তা করা হচ্ছে, সে উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আমাদের রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনা সবকিছুর ওপরে থাকবে। কিন্তু অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবটাও রাষ্ট্র ও জনগণের খাতিরেই করতে হবে। আমাদের দেশে কি যথেষ্ট অবকাঠামো আছে? কয়টি ক্লাউড সার্ভিস প্রোভাইডার এখানে আছে? কয়টি মানসম্পন্ন ডেটা সেন্টার আছে? কত বছর ধরে তারা এখানে সফলতার সঙ্গে সেবা দিয়ে যাচ্ছে? কী পরিমাণ লোকবল তাদের আছে? নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের সব ধরনের নিশ্চয়তা কি আছে? সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কী কী সক্ষমতা তাদের রয়েছে?

অন্যদিকে, বড় মাপের প্রতিষ্ঠানগুলোর আমাদের দেশে ডেটা সেন্টার স্থাপন করার প্রত্যাশা করছি আমরা। কিন্তু তাদের জন্য যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ কি আমরা সৃষ্টি করতে পেরেছি? বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত, আসিয়ানের সদস্যরাষ্ট্র ভিয়েতনামের কথাই ধরা যাক। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশের সূচকে (২০২০) তাদের অবস্থান আমাদের থেকে প্রায় ১০০ ঘর এগিয়ে (বাংলাদেশ ১৬৮, ভিয়েতনাম ৭০); থাইল্যান্ড–সিঙ্গাপুরের কথাতো বাদই দিলাম (থাইল্যান্ড ২১, সিঙ্গাপুর ২)।
ইতিমধ্যে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে কয়েকটি আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে খসড়া আইনটিতে থাকা বিভিন্ন ধরনের অস্পষ্টতা ও অসম্পূর্ণতা নিয়ে কথা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে আইনের প্রায়োগিক দিক নিয়ে। রাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠান উপাত্ত সুরক্ষা–সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে, সেটির কাঠামো, এখতিয়ার ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ নিয়েও পরামর্শ এসেছে। আলোচনা হয়েছে অতীতে হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে। এ ধরনের আইনের প্রয়োগ নিয়ে অংশীজনদের মাঝে যে একধরনের অনাস্থা বিরাজ করছে, সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আইন পাসের সময় খসড়া পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কা পর্যন্ত করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা (প্রথম আলো, ১০ আগস্ট, ২০২২)।

অনাস্থার এই জায়গাগুলোয় আরও গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নিতে না পারলে এসব আইনের সুফল পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনেককেই অনুযোগ করতে শোনা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হওয়ার সময় যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে তার প্রতিফলন ঘটেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, আইন আশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল হবে কেন? আর আপনিই–বা কেন আশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে আশা নিয়ে থাকবেন? আইনের যদি কোনো ফাঁকফোকর থাকে, আলোচনার মাধ্যমে, আইনবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করে, সেটির সমাধান আইনের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উপাত্ত সুরক্ষা আইন নিয়ে আরও যৌক্তিক মতামত দিয়ে, সেটিকে জুতসই করে তোলার দাবি জানানোর সময় এখনই। এই আইনের গুরুত্ব অনুধাবন কিছুটা কঠিন হলেও ভবিষ্যতে এটি যে আমাদের তথ্য-উপাত্তের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার রক্ষাকবচ হয়ে উঠবে, সেটি অচিরেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক    
Email: bmmainul@du.ac.bd