মতামত

বিএনপিকে ধরেবেঁধে নির্বাচনে না আনুন, অন্তত ‘ধরাবাঁধাটা’ ঠেকান

গত আগস্টে ইসির সংলাপে ২২টি রাজনৈতিক দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছিল। এর মধ্যে নয়টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে।
গত আগস্টে ইসির সংলাপে ২২টি রাজনৈতিক দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছিল। এর মধ্যে নয়টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে।

যাঁরা মনে করেন, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সাবেক নূরুল হুদা কমিশনের কোনো ফারাক নেই, তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত করছি। প্রথম কারণ, নূরুল হুদা কমিশন সরকারের ইচ্ছাপূরণ নির্বাচন করেছে ২০১৮ সালে। অর্থাৎ তারা পরীক্ষায় ডাহা ফেল করেছে। বর্তমান কমিশন এখনো পরীক্ষার প্রস্তুতিতে আছে। তা-ই এখনই চূড়ান্ত রায় দেওয়া যাচ্ছে না।

সাবেক নির্বাচন কমিশন, তথা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কথাবার্তায় মনে হতো, তাঁরা সরকারের ইচ্ছাপূরণের নির্বাচন করার জন্যই এসেছেন; যদিও এই পাঁচ কমিশনারের একজন—মাহবুব তালুকদার সত্য বলতে দ্বিধা করতেন না। বর্তমান ইসির কর্তাব্যক্তিরা মাঝেমধ্যে সত্য কথা বলার চেষ্টা করেন। তাঁদের কর্মকাণ্ড এখনো বৈঠক, আলোচনা, মতবিনিময় ও সংবাদ সম্মেলনে সীমিত।

নির্বাচনের অংশীজন কিংবা জনগণের ভাবনা নিয়ে নূরুল হুদা কমিশনের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তারা নির্বাচন নিয়ে কোনো সংকট ছিল, সে কথা স্বীকারই করতে চায়নি। বর্তমান সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল আভাসে-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করছেন, নির্বাচন নিয়ে দেশে একটি সংকট চলছে। কিন্তু তিনি বা তাঁর সহকর্মীরা বুঝতে পারছেন না, কীভাবে সেই সংকট কাটাবেন।

সবকিছু মিলে ইসির মধ্যে যে একধরনের অস্থিরতা চলছে, তা তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে বোঝাই যায়। প্রশ্ন উঠেছে, সংবিধান ইসিকে যে অবাধ ক্ষমতা দিয়েছে, তা কি এর পদাধিকারীরা প্রয়োগ করতে পারবেন, না অন্য কারও ইচ্ছাপূরণের সহযাত্রী হবেন? ইসি কতটা নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের সেই কাজকে অংশীজন, তথা জনগণ কীভাবে নিচ্ছেন।

ইসির দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় ধরাবাঁধা অবস্থার অবসান করা। আর সেই কাজ তাদের এখনই শুরু করতে হবে। দুঃখের বিষয়, বুধবার ইসি ঘোষিত রোডম্যাপ বা পথরেখায়  নির্বাচন নিয়ে চলমান সংকট সুরাহার কোনো ইংগিত পেলাম। বিএনপিকে ধরেবেঁধে নির্বাচনে না আনতে পারুক, নির্বাচন কমিশন অন্তত ‘ধরাবাঁধাটা’ ঠেকাতে পারত।

বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে ইসির পক্ষে শতভাগ স্বাধীনতা নিয়ে নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করা কেবল কঠিন নয়, অসম্ভবও। বিএনপির আমলে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনের সময় ভারপ্রাপ্ত সিইসি ছিলেন সফিউর রহমান, যিনি ছিলেন গণতন্ত্র মঞ্চের দৃঢ় সমর্থক। কোনোভাবে তাঁর বিএনপি সরকারের ইচ্ছা পূরণ করার কথা নয়। কিন্তু সেই উপনির্বাচনে কারচুপি ও জবরদখল ঠেকাতে পারেননি। এ জন্য সফিউর রহমান বিএনপির লোক হয়ে যাননি। মানুষ ভেবেছেন, তিনি চাইলেও নির্বাচনে যে পদ্ধতিগত কারচুপি ও জবরদস্তি হয়, সেটা মোকাবিলা করতে পারেননি।

বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারে ২৪ দফা দাবিতে আন্দোলন করেছিল এবং তা সফলও হয়েছিল। বিএনপি বা তাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ইচ্ছাপূরণের নির্বাচন করতে পারেননি। ১/১১-এর পরিবর্তনের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হলেও নির্বাচনী সংকট কাটেনি। আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বাতিল করেছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপস্থিতিতে কীভাবে সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট হবে, তার কোনো রূপরেখা তারা দিতে পারেনি। স্বীকার করতে হবে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তারা একটা আপসরফার চেষ্টা করেছিল। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনকালীন সরকার হবে। কিন্তু বিএনপি সেই প্রস্তাব মানেনি।

আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে, যাতে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিল। একইভাবে ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপিও অনুরূপ প্রস্তাব দিয়েছিল এবং যথারীতি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে তো বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করল। আওয়ামী লীগকে এ ধরনের একটি নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে, সেদিন বিরোধীদের জন্য যতটা না পরাজয়ের, আওয়ামী লীগের জন্য লজ্জার। আওয়ামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেনাশাসকদের দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগের শেষ পার্থক্যটুকু মুছে গেল।

বলছিলাম ইসির অস্থিরতার কথা। ইভিএম নিয়ে তারা সবচেয়ে বেশি অস্থিরতায় ভুগছে। একবার বলে, ইভিএম ব্যবহার করতে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রয়োজন। এ জন্য তারা ৩০টির বেশি দলের সঙ্গে কথাও বলল; যাদের বেশির ভাগই ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে। আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে অবস্থান নেয়। আলোচনা শেষে ইসি ১৫০টি আসনে ইভিএম ও ১৫০টি আসনে ব্যালটে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এ সিদ্ধান্ত ছিল অনেকটা আপসমূলক। এক পক্ষ ইভিএমের পক্ষে, আরেক পক্ষ বিপক্ষে। অতএব, তারা ১৫০=১৫০টি ড্র ঘোষণা করল। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা হলো। ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়ে আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এর পরদিনই সিইসি বললেন, রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে ৩০০ আসনে ব্যালটে নির্বাচন হতে পারে। গত ৩১ জুলাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে সিইসি বলেছিলেন, ‘অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না। এর ভেতরে কী জানি একটা আছে। আমরা অনেককেই আস্থায় আনতে পারছি না। ইভিএম বিষয়ে সংকট থেকে যাবে। ইভিএমে ভোট করলাম কি করলাম না, সেটা নয়; নির্বাচনটা নিরপেক্ষ, সঠিক, অবাধ ও নির্বিঘ্ন হলো কি না, সেটা ইভিএমে হোক, ব্যালটে হোক, সেটা হওয়াটা বড় কথা। কাজেই বড় ধরনের সংকট ওখানে নয়, আপনারাও জানেন, ওই সংকট নিরসন হলে নির্বাচনটা সুন্দরভাবে উঠে আসবে।’

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, গত আগস্টে ইসির সংলাপে ২২টি রাজনৈতিক দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছিল। এর মধ্যে নয়টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে। আরও পাঁচটি দল ইভিএম নিয়ে সংশয় ও সন্দেহের কথা বলেছে। কেবল আওয়ামী লীগসহ চারটি দল ইভিএমে ভোট চেয়েছে। বিএনপিসহ যে নয়টি দল ইসির সংলাপ বর্জন করেছিল, তারাও ইভিএমের বিপক্ষে।

ইভিএম বা ব্যালট বড় কথা নয়, সঠিক নির্বাচনই বড় কথা—এমনটা বললেও গতকালের বক্তব্যে বারবার ইভিএমের পক্ষেই বলেছেন সিইসি। ইভিএমকে দুর্বল যন্ত্র আখ্যা দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সিইসি বলেন, ‘যন্ত্র দুর্বল কি সবল, এটা ইসির বিবেচনা করার বিষয় নয়। সবল হওয়ারও দরকার নেই, দুর্বল হওয়ারও দরকার নেই। যন্ত্র কাজ করছে কি না, এটাই আসল বিষয়। ইভিএমে জালিয়াতি সম্ভব নয়।’

সিইসি সব রাজনৈতিক দল একমত হলে ব্যালটে ভোট করতে রাজি থাকার কথা বলেছেন। তাহলে ইভিএমে ভোট করার ক্ষেত্রেও একই যুক্তি খাটবে না কেন?

সিইসির প্রথম দিকের কথাবার্তায় মনে হয়েছিল, তিনি সত্যি সত্যি সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চাইছেন। সব দলকে সংলাপেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিএনপিসহ কয়েকটি দল আসেনি। তারা নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সিইসির কাছে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিএনপি না এলে কী করবেন? এর উত্তর ছিল, কমিশন সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চায়। কিন্তু কাউকে ধরেবেঁধে নির্বাচনে আনবে না। সেটা কমিশনের দায়িত্বও নয়।

কিন্তু যে কথা সিইসি বলেননি, তা হলো কমিশন কাউকে ধরেবেঁধে নির্বাচনে আনবে না, এ কথা ঠিক; কিন্তু কোনো দল যাতে নির্বাচনে না আসতে পারে, সে জন্য যদি কেউ তাদের ধরেবেঁধে রাখে (যেমন দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা, সভা-সমাবেশে হামলা, ভয়ভীতি দেখানো ইত্যাদি), সে ক্ষেত্রে কমিশনের দায়িত্ব কী হবে? তারা যদি সত্যি সত্যি সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন চায়, তাহলে কমিশনকে এই ধরাবাঁধা অবস্থা থেকে সব দলকে মুক্ত রাখতে হবে। মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এখন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন বিএনপিকে যে পরিবেশে নির্বাচন করতে বলা হচ্ছে, সেই পরিবেশে আওয়ামী লীগ কি নির্বাচন করত বিরোধী দলে থাকতে? অতীতে করেনি (নব্বই-পরবর্তী সময়ে)। ভবিষ্যতেও করবে বলে মনে হয় না।

অতএব, ইসির দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় ধরাবাঁধা অবস্থার অবসান করা। আর সেই কাজ তাদের এখনই শুরু করতে হবে। দুঃখের বিষয়, বুধবার ইসি ঘোষিত রোডম্যাপ বা পথরেখায়  নির্বাচন নিয়ে চলমান সংকট সুরাহার কোনো ইংগিত পেলাম না। বিএনপিকে ধরেবেঁধে নির্বাচনে না আনতে পারুক, নির্বাচন কমিশন অন্তত ‘ধরাবাঁধাটা’ ঠেকাতে পারত।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    sohrabhassan55@gmail.com