মতামত

‘থ্রি ইডিয়টস’-এর র‍্যাঞ্চোর বাপদের বলছি

‘মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁসবিষয়ক খবর পড়ার পর টের পাচ্ছি, ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির সেই জমিদারের মতো হাজার হাজার জমিদার টাইপের বাপ–মা আমাদের দেশে কিলবিল করছেন।’
‘মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁসবিষয়ক খবর পড়ার পর টের পাচ্ছি, ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির সেই জমিদারের মতো হাজার হাজার জমিদার টাইপের বাপ–মা আমাদের দেশে কিলবিল করছেন।’

‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির একেবারে শেষভাগে গিয়ে জানা যায়, দিল্লির অভিজাত ইম্পেরিয়াল কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং বা আইসিইতে পড়তে আসা তিন ‘ইডিয়টের’ মধ্যে যে সবচেয়ে মেধাবী, সেই রাঞ্ছোড়দাস শ্যামলদাস চাঁচড় ওরফে র‍্যাঞ্চো (এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমির খান) আসলে র‍্যাঞ্চো নয়।

কাহিনিতে দেখা যায়, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফল ঘোষণার পর র‍্যাঞ্চো প্রথম হওয়ার পর কাউকে কিছু না বলে হোস্টেল ছেড়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। ১০ বছর পর অপর দুই ‘ইডিয়ট’, অর্থাৎ র‍্যাঞ্চোর দুই বন্ধু ফারহান ও রাজু জানতে পারে, র‍্যাঞ্চোর বাড়ি শিমলা। তারা ঠিকানা জোগাড় করে। দিল্লি থেকে তারা শিমলা যায়। ঠিকানামতো শিমলার একটি বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়িতে গিয়ে তারা হাজির হয়। সেখানে গিয়ে তারা জানতে পারে, এত দিন ধরে কলেজে তারা যে র‍্যাঞ্চোকে চিনত, সে আসলে এই বাড়ির মালিকের ছেলে নয়। তার নামও র‍্যাঞ্চো নয়। সে এই বাড়ির চাকরের ছেলে। তাকে সবাই ‘ছোটে’ নামে চেনে। ছোটবেলায় ছোটের মা–বাবা দুজনই মারা যাওয়ায় বাড়ির মালিক এ বাড়িতেই তাকে রেখে দিয়েছিলেন।

ছোটের (আমির খান) মালিকের ছেলের নাম রাঞ্ছোড়দাস শ্যামলদাস চাঁচড় (এই নাম ব্যবহার করেই ছোটে আইসিইতে ভর্তি হয়েছিল); ডাকনাম র‍্যাঞ্চো। র‍্যাঞ্চো পড়াশোনায় ভালো ছিল না। অন্যদিকে ছোটে ছিল মেধাবী।

ছোটে বড় হওয়ার পর তার মালিক তাকে বলেন, ‘আমার ছেলে র‍্যাঞ্চো ইঞ্জিনিয়ার হোক, সেটা আমি চাই। কিন্তু তার পক্ষে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হওয়াই সম্ভব নয়। এখন সমাধান হলো, তুমি র‍্যাঞ্চোর পরিচয় নিয়ে দিল্লিতে গিয়ে আইসিইতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। তোমার সব খরচাপাতি আমি দেব। টাকা দিয়ে আমি আমার ছেলে র‍্যাঞ্চোর জন্য ডিগ্রিটা কিনব। তুমি পাবে শিক্ষা আর র‍্যাঞ্চো পাবে ডিগ্রি।’

মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁসবিষয়ক খবর পড়ার পর টের পাচ্ছি, ‘থ্রি ইডিয়টস’ ছবির সেই জমিদারের মতো হাজার হাজার জমিদার টাইপের বাপ–মা আমাদের দেশে কিলবিল করছেন। এই বাপ–মা তাঁদের ছেলেমেয়েদের ডিগ্রি কিনে দেওয়ার জন্য টাকার বস্তা নিয়ে বসে আছেন।

সে ক্ষেত্রে ছোটের (আমির খান) মতো ‘বদলি ছাত্র’ খোঁজার সময় তাঁদের নেই। তাঁদের কাজ সহজ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্টসংখ্যক ‘শিক্ষানুরাগী’ পাওয়া গেছে। এই শিক্ষানুরাগীদের হাতে কয়েক লাখ টাকা ধরিয়ে দিলে তাঁরা মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রশ্নপত্র শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দিয়ে থাকেন।

সিআইডি সদর দপ্তরে সংস্থাটির প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া গত রোববার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ১৬ বছরে কমপক্ষে ১০ বার মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

যাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন, যাঁরা বিক্রি করেন, যে অভিভাবকেরা কেনেন এবং এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের এক পর্বের নাটকটিকে যাঁরা ১০ বছরব্যাপী সিরিয়ালে নিয়ে গেছেন, তাঁরা সবাই একটা বিষয় খুব ভালো করে জানেন। সেটি হলো এই ডিগ্রি কেনা ডাক্তাররা যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন বহু রোগী ভুল চিকিৎসার শিকার হবেন, এমনকি মারাও যেতে পারেন। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না!

‘জনস্বার্থে’ এগিয়ে আসা এই ‘সামাজিক ব্যবসায়’ জড়িত থাকার অভিযোগে সিআইডি ১২ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে আবার সাতজনই চিকিৎসক। তাঁদের কেউ বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টারে, কেউবা প্রাইভেট পড়ানোর আড়ালে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারবার করতেন।

স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রেসের একজন মেশিনম্যানসহ সারা দেশে এই চক্রের সদস্য আছেন ৮০ জন। চক্রটি ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তারা ফি বছর দেড় শ জনের মতো ভর্তি করিয়েছে। এভাবে ভর্তি হওয়াদের বেশির ভাগই বড় ব্যবসায়ী, ডাক্তার ও সরকারি কর্মকর্তাদের সন্তান। সিআইডির তথ্যমতে, চক্রের সদস্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

তাহলে ঘটনা যা বোঝা গেল, তা হচ্ছে ব্যাপারটা হুটহাট করে ঘটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার মতো ঘটনা নয়। এক বছর-দুই বছর নয়, দশ–দশটা বছর ধরে এই কাণ্ড ঘটেছে। এটি কখনো কখনো হয়তো ক্ষমতাধর কাউকে কিছুটা বিচলিত করেছে। সেই মতো তিনি বা তাঁরা বিবিধ নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু নিট ফল শূন্যই থেকে গেছে। প্রশ্নপত্র যেমন ফাঁস হওয়ার, তেমনই হয়েছে এবং হচ্ছে। মানে একটা সিস্টেমেটিক কায়দায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই অতি অর্থকরী শিল্প গড়ে উঠেছে। ‘ডিগ্রি অর্জনের নয়, কেনার বিষয়’—এমন একটি দার্শনিক ভাষ্যের ভিত প্রশ্নপত্রের ক্রেতা-বিক্রেতারা তলেতলে গড়ে তুলেছেন।

সেই ভিতের ওপর যে বাস্তবতা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, তা হলো সামনের বেঞ্চির মেধাবী ছেলেটি বা মেয়েটি ফাঁস করা প্রশ্নপত্রের গুঁতোয় ছিটকে পড়ে যাচ্ছে। মেধা থাকার পরও সে ডাক্তার হতে পারছে না। অন্যদিকে বাবার ক্ষমতা আর টাকার জোরে লাস্ট বেঞ্চির ছেলেটি বা মেয়েটি ঘরে ঢুকেই গরম ভাত পাওয়ার কায়দায় পরীক্ষার হলে ঢোকার আগেই হাতে প্রশ্নপত্র পেয়ে যাচ্ছে। আর্থিক যোগ্যতামানে উত্তীর্ণ এই ‘জমিদারপুত্র র‍্যাঞ্চোরা’ পড়াশোনা বাইপাস করে ডাক্তার হয়ে যাচ্ছে।

সিআইডির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ফাঁস করা প্রশ্নপত্র এ পর্যন্ত কমপক্ষে দুই হাজার ডাক্তার পয়দা করেছে। এই চিকিৎসকেরা আমার–আপনার চিকিৎসা করছে।

সদ্য উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি পাস করা একজন ছেলে বা মেয়ের পক্ষে ফাঁস করা প্রশ্নপত্র লাখ লাখ টাকা দিয়ে জোগাড় করা সম্ভব নয়। অনেকের মাথায়ও হয়তো বিষয়টি থাকে না। কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পল্টু স্যার, বল্টু স্যাররা বেছে বেছে ধনী বাবার ছেলেমেয়েদের নিশানা করে তাদের মাথায় এই জিনিস ঢুকিয়ে দিয়ে থাকেন। সেই শিক্ষার্থীরা তারপর তাদের মা–বাবার কাছে তখন ‘টাকা চাহিয়া আবেদন’ করে থাকেন।

এর বাইরে হয়তো অনেক বাবা আছেন যাঁরা তাঁদের নিজের স্ত্রীকে রত্নগর্ভা প্রমাণ করার জন্য অমেধাবী সন্তানের জন্য ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর র‍্যাঞ্চোর বাপের মতোই উচ্চ মূল্যে ডাক্তারির ডিগ্রি কিনতে আগ্রহী হয়ে থাকেন।

এই বাপের যে ছেলেটি বা মেয়েটি ভর্তিই হয় র‍্যাঞ্চোর মতো দুই নম্বর কায়দায়, সে এক নম্বর পথে, মানে পড়াশোনা করে ডাক্তার হবে, তা তার বাপ–মায়ের পক্ষেও আশা করা কঠিন। তার ডাক্তারি পাঠের পরবর্তী ধাপগুলোর উত্তরণ তথা পাস করার পেছনে একই ধরনের বাইপাস সার্জারির কাজ করার কথা। ফলে তার সর্বরোগের চিকিৎসায় ‘প্যারাসিটামল তিন বেলা’ লেখা ডাক্তার হওয়ারই কথা। চিকিৎসক-জীবনের প্রথম দিন থেকেই তার মাথায় বিনিয়োগ করা টাকা পুনরুদ্ধারের ভাবনা গেঁথে যাওয়ার কথা। এর মধ্য থেকে দু একজন ব্যতিক্রম থাকতেও পারেন যাঁরা অসদুপায়ে ভর্তি হলেও পরে ক্লাসে গিয়ে মনোযোগী হয়ে যথার্থ চিকিৎসক হয়েছেন। কিন্তু সেই সংখ্যা যে অনুবীক্ষণিক তা বোঝার জন্য ডাক্তারি পড়ার দরকার হয় না।

যাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন, যাঁরা বিক্রি করেন, যে অভিভাবকেরা কেনেন এবং এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের এক পর্বের নাটকটিকে যাঁরা ১০ বছরব্যাপী সিরিয়ালে নিয়ে গেছেন, তাঁরা সবাই একটা বিষয় খুব ভালো করে জানেন। সেটি হলো এই ডিগ্রি কেনা ডাক্তাররা যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন বহু রোগী ভুল চিকিৎসার শিকার হবেন, এমনকি মারাও যেতে পারেন। ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল না!

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    ই-মেইল: sarfuddin2003@gmail.com