মতামত

দেশে দারিদ্র্য আর বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়ার ‘রূপকথা’

শৈশব-কৈশোরে রূপকথার সঙ্গে কমবেশি সবারই পরিচয় হয়। ঠাকুরমার ঝুলি, জলপরি, দৈত্য–দানব কিংবা সিনড্রেলা, স্লিপিং বিউটি থেকে ফ্রগ প্রিন্স বা হবিট। বড় বয়সে এসেও এমন কিছু শোনা বা জানা হয় আমাদের, যা রূপকথার চেয়ে কম বিস্ময়কর তো নয়ই, বরং ক্ষেত্রবিশেষে পরিণত মন আরও বেশি দুলে ওঠে তার অভিঘাতে! এই যেমন ২০২০ সালের পর সারা বিশ্বে যত সম্পদ তৈরি হয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশই গেছে মাত্র ১ শতাংশ মানুষের দেরাজে, বাকি এক-তৃতীয়াংশের মালিকানা ভাগাভাগি হয়েছে ৯৯ শতাংশ মানুষের মধ্যে। তথ্য-উপাত্ত থাকার পরও এ খবর যতটা অবিশ্বাস্য মনে হয়, ততটাই বিশ্বাস বুকের ভেতর জিইয়ে থাকে—সভ্যতা মানে সাম্যের গান, মানবিক মর্যাদার অনিঃশেষ বয়ান। কিন্তু ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর সেই পাগল যেন চিৎকার করে ওঠে, ‘তফাত যাও, তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।’

যে কথা বিস্ময়াভূত করে এবং সত্যিকার অর্থেই যা শুনে চোখ কপালে ওঠে, তা রূপকথা না হয়ে যায় কীভাবে! একে পুঁজি শাসিত ও অর্থ-পূজিত এই সময়ের ‘রূপকথা’ বলা কি অতিরঞ্জন হয়? নাকি এতে রূপকথার সংজ্ঞায় অদলবদল ঘটে? ধারণা করা চলে, এর পক্ষে ৮০০ কোটি বিশ্ববাসীর অন্তত সাড়ে ৭০০ কোটির সায় জানানোর কথা। কিন্তু হাত ওপরে তোলার, কণ্ঠ ছাড়ার সেই ‘তাকত’ কি তাদের সবার আছে? এখনো যে প্রতি রাতে ৮২ কোটি মানুষ খালি পেটে ঘুমাতে যান। বিশ্বজুড়ে ১৭০ কোটি শ্রমিকের মজুরি বাড়ার হার হার মেনেছে মূল্যস্ফীতির কাছে। অর্থাৎ, তাঁদের প্রকৃত মজুরি কমেছে, এর মানে তাঁদের পেটেও টান পড়েছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে যুদ্ধবিগ্রহে বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ মানুষের দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে।

করোনা মহামারির ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গরিবি বেড়েছে—এটা জানা তথ্য। দেশে দেশে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে কতজন পড়ে গেছেন, তা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি তথ্যে ফারাক আছে বটে, কিন্তু হাহাকার কারও কানই এড়ায়নি।

একদল মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে একটি পয়সাও শোধ করেন না, কিন্তু তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে ‘রাষ্ট্রীয় জামাই আদর’। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেশে থেকে পাচার হয়ে যায়, কিন্তু কারও যেন কিচ্ছু করার নেই। সুইচ ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমে, কানাডা, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশে গড়ে ওঠে ‘বেগমপাড়া’। শিল্পপতি, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ‘জনগণের কামলা’—কে নেই সেই তালিকায়!

বাংলাদেশেও সে সময় বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের করা জরিপে অভিন্ন চিত্র পাওয়া গিয়েছিল। করোনা অনেকটাই বাগে আসার পর ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার খানিকটা কমতে শুরু করে। কিন্তু ২০২২ সালে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে আসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর জেরে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি আবার থমকেই যায়নি শুধু, জ্বালানির সংকট ও এর মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষ। কিন্তু এর বিপরীতে ‘ঈশ্বর থাকা পল্লির’ ছবিটি বহুবর্ণা। অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল বলছে, তিন বছর ধরে অতিদরিদ্র ও অতিধনীর সংখ্যা একইভাবে বেড়েছে। অর্থাৎ বিশ্বব্যবস্থা এমন ‘নীতিমালা’য় চালিত, একদিকে গরিবি বাড়বে মড়ক লাগার মতো, অন্য প্রান্তে সম্পদ উপচে পড়বে বলক দেওয়া ভাতের মতো। ‘সারভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট’ শিরোনামের প্রতিবেদন তারই আরেক সিলমোহর।

অক্সফামের হিসাবে, ২০২০ সালের পর বিশ্বে ৪২ ট্রিলিয়ন (৪২ লাখ কোটি) ডলারের সম্পদ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ (৬৩ শতাংশ) গেছে ইলন মাস্ক, গৌতম আদানিদের মতো ১ শতাংশ শীর্ষ ধনীর সিন্দুকে। বাকি ৩৭ শতাংশ বা ১৬ ট্রিলিয়ন ডলারের সম্পদ ভাগ হয়েছে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ মানুষের মধ্যে। আরেকটা হিসাব এমন—সমাজের নিচের দিকের ৯০ শতাংশ মানুষের ১ ডলার আয়ের বিপরীতে ধনবানদের আয় ১৭ লাখ ডলার।

ঝুটের রাজ্যে এই ‘সত্য’ থেকে কীভাবে তফাতে থাকবেন? ২০২২ সালে শীর্ষ ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির প্রধান দুই কারণ—খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। গত বছর ৯৫টি খাদ্য ও জ্বালানি কোম্পানি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ মুনাফা করেছে। গত বছর তাদের সম্মিলিত মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০৬ বিলিয়ন (৩০ হাজার ৬০০ কোটি) ডলার।

এই হিসাবে সেই সাত সমুদ্দুর তেরো নদীর ওপারের দেশ, ইউরোপ, আমেরিকা সবাই আছে, কিন্তু স্বদেশের কিছু ‘হিসাব’ যে আরও দুর্বোধ্য ঠেকে। একদল মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে একটি পয়সাও শোধ করেন না, কিন্তু তাদের জন্য বরাদ্দ থাকে ‘রাষ্ট্রীয় জামাই আদর’। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেশে থেকে পাচার হয়ে যায়, কিন্তু কারও যেন কিচ্ছু করার নেই। সুইচ ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমে, কানাডা, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশে গড়ে ওঠে ‘বেগমপাড়া’। শিল্পপতি, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ‘জনগণের কামলা’—কে নেই সেই তালিকায়!

সর্বশেষ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপির প্রতিবেদনে অভিযোগ পাওয়া গেল, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি কিনেছেন। তিনি এই সম্পদের তথ্য নির্বাচনী হলফনামায় দেননি এবং বিষয়টি জানার পর নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলে দিয়েছে, এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। আমাদেরও কি কিছু করার আছে? আমরা বরং ওএমএসের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবতে পারি, ‘এ–ও কি কম কথা! দেশের মাটি-জল-হাওয়া এত ঊর্বর ও অনুকূল যে এখানে ‘গোলাপদের’ বাম্পার ফলন হয়। কিন্তু তাদের সাজিয়ে রাখার মতো ‘ফুলদানি’নেই দেশে, তাই তারা শোভা পায় ভিনদেশের ড্রয়িংরুমে!

  • হাসান ইমাম সাংবাদিক
    hello.hasanimam@gmail.com