রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের শতভাগ বিদেশ নির্ভরতা বিপজ্জনক

ড. বদরূল ইমাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভূমিকা, এর ঝুঁকি, বাংলাদেশের জনবল সক্ষমতা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ বিষয়ে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

ড. বদরূল ইমাম
প্রশ্ন

২০২৩ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা। দেশের বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ ও ঘাটতি মোকাবিলায় এই বিদ্যুৎ কতটা ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?

বদরূল ইমাম: নতুন নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ২০২৪ সালে। কিন্তু বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির আওতায় সঞ্চালন লাইন নির্মাণ সম্পন্ন না হওয়ায় এই বিদ্যুৎ সে সময়ের মধ্যে জনগণের কাছে পৌঁছাবে বলে মনে হয় না। সঞ্চালন লাইনের মধ্যে দুটি নদী পার হওয়ার বিষয় রয়েছে। সেই কাজটি ঠিকভাবে করে সময়মতো লাইন প্রস্তুত করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। সবকিছু বিবেচনায় নিলে আমরা আশা করতে পারি যে ২০২৫ সালে এ বিদ্যুৎ জনগণ ব্যবহার করতে পারবে। এ সময় প্রথম ইউনিট থেকে প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট ও তার পরের বছর দ্বিতীয় ইউনিট থেকে প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানের বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এ সময়ের মধ্যে অবশ্য বেশ কিছু বড় কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে।

প্রশ্ন

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল ষাটের দশকে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে যথেষ্ট সময় নেওয়া হয়েছে। এরপরও নানা ঝুঁকির কথা বিশেষজ্ঞ মহল থেকে শোনা যাচ্ছে, কেন?

বদরূল ইমাম: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব প্রথম ১৯৬১ সালে গৃহীত হয় এবং ১৯৬৩ সালে পাবনায় পদ্মা নদীর তীরে রূপপুর গ্রামে ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার সহযোগিতায় ১০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা অনুমোদন করে। পরে একটি রিঅ্যাক্টরের পরিবর্তে দুটি ১২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রিঅ্যাক্টরের সমন্বয়ে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়, যা বর্তমানে নির্মাণাধীন।

যেকোনো বৃহৎ প্রযুক্তিনির্ভর অবকাঠামোতে ঝুঁকির উপাদান কমবেশি থাকতে পারে। এ ব্যাপারে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিশেষ আলোচনায় আসার কারণ হলো পারমাণবিক দুর্ঘটনা অন্য যেকোনো দুর্ঘটনার চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর, ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বিশ্বে অতীতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বড় আকারের দুর্ঘটনা ঘটার দৃষ্টান্ত রয়েছে। চেরনোবিল ও ফুকুশিমা ইত্যাদির কথা বলা যায়। তারপরও বিশ্বের বহু দেশ দুর্ঘটনারোধী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রেখেছে। ঝুঁকি রোধের কার্যকারিতা নির্ভর করে কতটা উন্নত আধুনিক ঝুঁকিরোধী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলো এবং এই প্রযুক্তি ব্যবহারে জনবলের কারিগরি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কত তার ওপর। বাংলাদেশের নিজস্ব কারিগরি দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব এ ক্ষেত্রে একটি দুর্বলতা বটে। যেকোনো দুর্ঘটনাজনিত বা বিপৎকালীন পরিস্থিতিতে পুরোপুরি বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হলে দেশীয় মহলে একটি সংশয় থেকেই যায়।

প্রশ্ন

বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা এবং খুবই ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এ ধরনের আর কোনো দেশে কি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে নির্মাণের এই বিষয়গুলো কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল বলে মনে করেন?

বদরূল ইমাম: পৃথিবীতে বাংলাদেশের মতো এত ঘনবসতিপূর্ণ কোনো দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে বলে আমার জানা নেই। রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগে এর ফিজিবিলিটি স্টাডি করার সময় বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। তবে আমাদের দেশের মতোই পরিবেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের। ভারত সরকার সেখানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা নাকচ করে দেয়।

এ ধরনের প্রকল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিপৎকালীন ইভাকুয়েশন প্ল্যান বা নিরাপদ স্থানান্তর পরিকল্পনা। কখনো কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। সাধারণ ব্যবস্থাপনায় এ রকম দুর্ঘটনা ঘটলে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য লোকজনকে তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে থেকে অন্তত ২০ কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নিতে হয়। পাবনার রূপপুরের আশপাশের এলাকা দেশের অন্যান্য এলাকার মতোই ঘনবসতি পূর্ণ। এমন বাস্তবতায় কোনো সংকট দেখা দিলে আশপাশের জনগোষ্ঠীকে কীভাবে, কোথায় ও কত তাড়াতাড়ি অন্যত্র সরানোর ব্যবস্থা করা যাবে কিংবা কীভাবে সেই প্রস্তুতি নেওয়া হবে, তার কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করাও জরুরি।

প্রশ্ন

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি খুবই সংবেদনশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা। এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাগত রক্ষাকবচ নিশ্চিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এই নিরাপত্তাগত কোনো উদ্বেগ আছে বলে মনে করেন কি?

বদরূল ইমাম: রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজে নিয়োজিত রাশিয়ার পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের তথ্য অনুযায়ী রূপপুরে স্থাপিত পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর দুটি থার্ড জেনারেশন প্লাস শ্রেণির অত্যাধুনিক ভিভিআর-১২০০ মডেলের। এসব রিঅ্যাক্টরে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা রয়েছে। রোসাটমের মতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কথা হলো দুর্ঘটনা সব সময়ই আকস্মিকভাবে ও অপ্রত্যাশিতভাবে আসে, কখনোই ঘোষণা দিয়ে আসে না। রূপপুরের প্রযুক্তি অত্যাধুনিক হতে পারে। তবে তা নিশ্চয়ই চঁাদে যাওয়া-আসা করা অ্যাপোলো চন্দ্রযানগুলোর প্রযুক্তির সমকক্ষ নয়। নাসা পরিচালিত একটি অ্যাপোলো যানও তো চাঁদে যাওয়ার পথে একবার দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়ে যায়। আসলে নিশ্ছিদ্র নিরাপদ বলে কিছু নেই। আর আমাদের সমস্যা বেশি, কারণ আমরা তথ্য আদান–প্রদান বা তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুবই দুর্বল। রূপপুর বাংলাদেশের এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। কিন্তু এটি নিয়ে তো সংসদে কোনো আলোচনা বা বিতর্ক শুনি না। এর ভালো–মন্দ প্রশ্নে ব্যাপক জনসচেতনতা নেই, বিশেষ করে যে এলাকায় এটি হতে যাচ্ছে, সেখানকার জনগণের মধ্যে সচেতনতা কতটুকু, তা এক বড় প্রশ্ন।

প্রশ্ন

রাশিয়ার ঋণের অর্থে ও তাদের বানানো এই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন মূলত রাশিয়ান ও সঙ্গে ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কাউকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে কাজের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত বা দক্ষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর ঝুঁকি কতটা?

বদরূল ইমাম: রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর এটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন রাশিয়ানরা। এ ছাড়া ভারতীয় একটি দল কোনো কোনো বিষয়ে দায়িত্ব পালন করবে বলে জানা যায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশি দল এর পরিচালনার দায়িত্ব নিজেদের হাতে নিতে পারবে না। এটি আমাদের জন্য বড় দুর্বলতা বটে। বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও কারিগরি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ এগিয়ে চলেছে বটে কিন্তু কেন্দ্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বর্তমানে আমরা পুরোপুরি মাত্রায় বিদেশনির্ভর। এ নির্ভরতা থেকে কবে বের হতে পারব, তা কেউ বলতে পারে না।

ষাটের দশকে ভারতের খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী হোমি ভাবার হাত ধরে ভারতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কার্যক্রম শুরু হয়। এবং আজ পর্যন্ত সেখানে যত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হয়েছে, তা বানানো ও পরিচালনার দায়িত্বে মূলত ভারতীয়রা রয়েছেন। ১৯৬৯ সালে প্রথম নির্মিত ২০০ মেগাওয়াটের তারাপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ধীরে ধীরে বড় আকারের কেন্দ্র বানানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করে ভারত আজ এ ক্ষেত্রে সক্ষম একটি দেশ। কিন্তু আমরা নিজেদের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই পুরোপুরি বিদেশনির্ভর হয়ে ২৪০০ মেগাওয়াটের বিরাট আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছি, যার পরিচালনার দায়িত্ব আমরা কবে নিতে পারব, তা জানি না। আমাদের এই শতভাগ পরনির্ভরশীলতার অবশ্যই বড় ঝুঁকি রয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা বা অন্য যেকোনো বিষয়ে মতানৈক্য হলে বাংলাদেশ সব সময় অপর পক্ষের মত ও মর্জিকে মেনে নেওয়ার চাপে থাকবে।

প্রশ্ন

প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অর্থনৈতিক বিবেচনায় কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন? অনেকে বলছেন যে অর্থ ব্যয় করে রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, তার অনেক কম খরচ করেই অ-পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের মাধ্যমে এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। তাহলে কোন বিবেচনায় এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে?

বদরূল ইমাম: রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের সোয়া লাখ কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয় অবশ্যই অনেক বড় অঙ্কের টাকা। তবে এ ছাড়াও কেন্দ্র পরিচালনা ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, জ্বালানি ব্যয়, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও সবশেষে কেন্দ্র ডিকমিশনিং ব্যয় বিবেচনায় আনলে খরচের খাতা আরও অনেক ভারী হবে। তাই এ কথা ঠিক যে এই অত্যধিক খরচে রূপপুর কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, যদি ওই অর্থেই অনেক সংখ্যক অ-পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তবে কয়লা বা তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যে দূষণ তৈরি করে, পারমাণবিক কেন্দ্র তা করে না। আবার পারমাণবিক কেন্দ্রবিরোধী লবি বা গোষ্ঠীর দাবি পারমাণবিক কেন্দ্র তেজস্ক্রিয় দূষণ বয়ে আনতে পারে। বিশ্বব্যাপী এ বিতর্ক চলবেই, কিন্তু বাস্তবতা হলো রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ বছর দুয়েকের মধ্যেই শেষ হবে। এটি হওয়ার পরিকল্পনা আজ নয়, বরং বহু বছর আগে থেকে শুরু হয়। পারমাণবিক কেন্দ্র চালু হলে বাংলাদেশে বহুমুখী জ্বালানির ব্যবহারে নতুন মাত্রা যোগ হবে। কেবল তা–ই নয়, অনেকের মতে, বাংলাদেশ এর মাধ্যমে পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করবে, যা দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করবে।

প্রশ্ন

রূপপুরে উৎপাদিত বিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি মূল্য কত পড়তে পারে? এই বিদ্যুৎ কি সাশ্রয়ী হবে?

বদরূল ইমাম: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এক গবেষণামূলক জরিপে দেখানো হয়েছে যে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি উৎপাদন ব্যয় হবে ৯ দশমিক ৩৬ সেন্ট (বাংলাদেশি ৭ দশমিক ৯৪ টাকা) যেখানে ভারতের কুদামকুলান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তা ৫ দশমিক ৩৬ সেন্ট। রূপপুরে খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ার কারণ এর অত্যধিক নির্মাণ ব্যয় (১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার)। তবে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমগুলো বলেছে যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় হবে ৪ দশমিক ৫০ টাকা। তবে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের দামে এর কি প্রভাব পড়বে, তা দেখার বিষয়।

প্রশ্ন

এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে ৯০ ভাগ রাশিয়ার ঋণে। অনেকে বলছেন, ঋণ পরিশোধের চাপ বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। আপনার মন্তব্য কী?

বদরূল ইমাম: বাংলাদেশ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া আরও বেশ কিছু মেগা প্রজেক্ট বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করে বাস্তবায়ন করছে। তবে এগুলোর মধ্যে রূপপুরের ঋণ আকাশচুম্বী, অর্থাৎ রূপপুর কেন্দ্রের মোট ব্যয়ের ৯০ শতাংশ, যার পরিমাণ প্রায় ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। এর ওপর সুদ হিসাবে বড় অঙ্কের অর্থও পরিশোধ করতে হবে। সাধারণভাবেই এটি ধারণা করা যায় যে এত বড় ঋণ পরিশোধের চাপ বাংলাদেশ অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে।

প্রশ্ন

রূপপুরের পর বাংলাদেশে আরও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুতের ভবিষ্যৎকে কীভাবে দেখছেন?

বদরূল ইমাম: পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো, ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রমের দায়িত্ব নেওয়ার নিজস্ব কারিগরি সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। যেহেতু রূপপুরের অভিজ্ঞতা আমাদের পুরোপুরি বিদেশনির্ভর করে রেখেছে এবং বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন অন্য ধারার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চেয়ে যেহেতু বহু গুণে ব্যয়বহুল, তাই বর্তমানে বাংলাদেশের আর নতুন কোনো বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের ব্যাপক ঘনবসতি এখানে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে বড় বাধা। তবে বাংলাদেশ নতুনতর পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহারের দিকে নজর দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্মল মডিউলার রিঅ্যাক্টরনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা যৌক্তিক। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র ১০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হতে পারে। এগুলো ছোট আকারের হয়ে থাকে, যা কি না ট্রাক বা রেল পরিবহনের মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করা যায়।

বিশ্বজুড়ে অনেক উন্নত দেশ পরিবেশবান্ধব না হওয়ায় বৃহৎ সনাতনী পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে। বরং সমগ্র বিশ্বে এখন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ, বিশেষ করে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে বিশাল ব্যয়, তা নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ করা হলে তা হবে টেকসই ও যথার্থ। বাংলাদেশকে সেই পথেই অগ্রসর হতে হবে।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

বদরূল ইমাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।