৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ ছাপিয়েছে পত্রিকাগুলো। টক শোতে ‘টকিং’ হয়েছে এন্তার। অতএব নতুন কিছু বলার নেই। বলার আছে এতটুকুই যে এটা সহজ-সরল বিবেচনায় নির্বাচন হয়নি। তবে ৭ জানুয়ারি নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছিল, যাকে অনেকেই সগর্বে নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
গণতন্ত্রের তরিকা বহুবিধ। ২৪ জানুয়ারি সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানলাম, থাইল্যান্ডের মুভ ফরওয়ার্ড নামের রাজনৈতিক দলের নেতা পিটা লিমজারোয়েনরাতের সংসদ সদস্যপদ বহাল রেখে সে দেশের উচ্চতম আদালত এক রায় দিয়েছেন। গত বছর তাঁর দল থাইল্যান্ডের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু সে দেশের সেনা নিয়ন্ত্রিত সংসদের উচ্চকক্ষ পিটা লিমকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি।
তা ছাড়া তাঁর সংসদ সদস্যপদ স্থগিত করা হয় এই অভিযোগে যে একটা ‘মিডিয়া হাউসে’ তাঁর শেয়ার ছিল। সে দেশের আইন অনুযায়ী ‘মিডিয়া হাউসের’ মালিকানা বা মালিকানার ভাগ আছে—এমন কেউ সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য।
অবশ্য মামলায় পিটা লিমের আইনজীবীরা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে সেই মিডিয়া হাউস অচল বা নিষ্ক্রিয়। অর্থাৎ তিনি সক্রিয়ভাবে সংবাদ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। অতএব আইন ভঙ্গ করেননি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে আমাদের দেশে মিডিয়ার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হলে কতজন বাদ পড়তেন। তাই বলছিলাম, হরেক দেশে গণতন্ত্রের হরেক তরিকা।
আমাদের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে ধনতান্ত্রিক দেশ, এ দাবি নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না। দেশটির উচ্চকক্ষ হলো সিনেট, সেখানে সদস্য অর্থাৎ সিনেটরের সংখ্যা ১০০। প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের ভৌগোলিক আয়তন, জনসংখ্যানির্বিশেষে সিনেটরের সংখ্যা ২। যেমন প্রায় ১০ লাখ লোকের অঙ্গরাজ্য মন্টানা থেকে নির্বাচিত হন দুজন সিনেটর। পক্ষান্তরে দুই কোটি জনসংখ্যার নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেটরের সংখ্যাও ২।
বাইডেন, ওবামা, বিল ক্লিনটন প্রথমে হয়েছিলেন সিনেটর, তারপর প্রেসিডেন্ট। অন্য রুট হলো প্রথমে গভর্নর, তারপর প্রেসিডেন্ট। যেমন ছোট বুশ, রোনাল্ড রিগ্যান, জিমি কার্টার প্রমুখ। এই ধনতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ১০০ সিনেটরের পেশাগত যোগ্যতার একটা তালিকায় চোখ বোলালাম। মোটাদাগে দেখে বোঝা গেল, কমবেশি ৫৫ জন ছিলেন আইনজীবী। ২০ থেকে ২৫ জন সমাজকর্মী ও বিভিন্ন বিষয়ে উপদেষ্টা (কনসালট্যান্ট)। নামের পাশে পেশার ঘরে ব্যবসায়ী লেখা আছে আধা ডজনবার। এ সময় ব্যতিক্রম ডোনাল্ড ট্রাম্প। ব্যবসা থেকে একলাফে প্রেসিডেন্ট।
আমরা তো উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছি। সবার হাতেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। যে যেদিকে পারছে, ব্যবসা করছে। তাই ৭ জানুয়ারি সাচ্চা নির্বাচন হয়েছে—এমন কথা বলা ব্যক্তিরা দাবি করছেন যে আমাদের প্রায় ৭০ শতাংশ সংসদ সদস্যই যে ব্যবসায়ী, সেটা আমাদের ধনতান্ত্রিক বিকাশের প্রতিফলন। স্পষ্টতই আমাদের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শেখার অনেক কিছু আছে। বিল গেটস, জাকারবার্গ, জেফ বেজোসরা আমাদের ব্যবসায়ী-সংসদ সদস্যদের পদানুসরণ করে ও শিক্ষা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে এখন হয়তো নেমে যাবেন। তবে জনগণের ভোট সম্ভবত পাবেন না। স্পষ্টতই আমেরিকানদের চেয়ে আমাদের ব্যবসায়ী-প্রীতি অনেক বেশি।
গতস্য শোচনা নাস্তি—যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। চিন্তা এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে। আবার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। ৯ মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল-মে, অর্থাৎ অন্তত তিন মাস ধরে দুটি সিটি করপোরেশন, কমবেশি ৪৯০টি উপজেলা, বেশ কিছু পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচন হবে। এর মধ্যে বড় নিশ্চয়ই ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচন। তারপর ধাপে ধাপে পবিত্র রমজানের আগে এবং ঈদের পরের দুই মাসে শ পাঁচেক উপজেলা পরিষদের নির্বাচন।
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত হয়েছে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ করা হবে না। অবশ্য এটা চিরস্থায়ী সিদ্ধান্ত নয়, অর্থাৎ এ সিদ্ধান্ত পাল্টে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হতেও পারে। সেটা সময়ই বাতলাবে। প্রশ্ন থাকছে, ধানের শীষ মার্কা নিয়ে কেউ নির্বাচন করবে কি না। অর্থাৎ এই মার্কার জিম্মাদাররা স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য মার্কা ব্যবহারের অনুমতি দেবেন কি না।
যেকোনো অবস্থান বা সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে এন্তার যুক্তি থাকে। আমরা বিতর্ক চালিয়ে যেতে পারি অনন্তকাল। বিতর্ক দীর্ঘায়িত না করে একটা উপসংহার অকপটে ফাঁস করে দিই। বিরোধীরা, অর্থাৎ মূলত বিএনপি যদি আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো বর্জন করে, তাহলে মাঠপর্যায়ে দলটি দুর্বল হয়ে পড়বে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা চাঙা হয়ে উঠবেন, ভোটের খেলায় নামবেন, মিটিং-মিছিল করবেন, প্রতিপক্ষের ওপর টেক্কা মারার চেষ্টা করবেন, অর্থাৎ দিকে দিকে হইহই রইরই পড়ে যাবে।
এক যুগ যাবৎ কেন্দ্র থেকে নির্দেশিত হয়ে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জাতীয় ইস্যু নিয়ে, অর্থাৎ সরকার পতন, খালেদা জিয়ার মুক্তি, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি ব্যাপারে ছিলেন মশগুল। স্থানীয় বিষয়গুলো, অর্থাৎ উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের মানুষের সুখ-দুঃখ, তাঁদের ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ, ডিম, আলু, পেঁয়াজ এবং এই সপ্তাহে যুক্ত হওয়া চালের দাম ইত্যাদির ব্যাপারে মনঃসংযোগ করার ফুরসত পাননি। তারপরও জাতীয় আন্দোলনে যোগ দিয়ে সরকারের ধরপাকড়ের শিকার হয়েছেন হাজারে হাজার।
বিএনপি ও সমমনা দলের উপজেলা পর্যায়ের নেতারা নিশ্চয়ই চাইবেন তাঁদের নিজ নিজ এলাকার নির্বাচন ঘিরে স্থানীয় সংগঠনকে চাঙা করতে। আগামী দু-তিন মাসের এ সুযোগ হাতছাড়া করলে বিএনপিসহ বিরোধীদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ দলের নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করার, মাঠে নামানো, স্থানীয় নেতৃত্ব ফিরে পাওয়া এবং স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত হয়ে লোকাল আমলাতন্ত্রকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে রাখার পরবর্তী সুযোগ এক অর্থে ২০২৮ সালের আগে আর আসবে না, যদি না এর আগে কোনো কারণে এ সংসদ ভেঙে যায় এবং নির্দলীয় ব্যবস্থায় নতুন নির্বাচনের আয়োজন হয়।
অন্তত যে ৫৮টি আসনে আওয়ামী লীগের ‘স্বতন্ত্র দল’ সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে, সেই স্থানগুলোয় আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই অনেক ধারায় দ্বিধাবিভক্ত। ফলে অন্তত এসব সংসদীয় আসনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধীদের অবশ্যই আসা উচিত। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে অন্যান্য স্থানে তাদের সুযোগ ও সম্ভাবনা কম। সারা দেশে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের এ সুযোগও হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
আগেই বলেছি, যেকোনো বিষয়ই পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্কের ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। অনেকে অবশ্য বলবেন যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যোগ দিলে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন না করার অবস্থান থেকে সরে আসার শামিল হবে। আওয়ামী লীগ সরকারকে বৈধতা দেওয়া হবে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে নেওয়া হবে। যুক্তিগুলো অকাট্য। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে না নিয়ে, বর্তমান সরকার হটিয়ে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তৈরি করে তার অধীন নির্বাচন করার দাবি চালু অবশ্যই থাকবে, তবে বিকল্প চিন্তা করতে বাধা কোথায়।
শেষের কথা, গত দেড় বছরের আন্দোলনে বিএনপি জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও ব্যবসায় পক্ষপাতিত্ব, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের দুর্দশাসহ যে বিষয়গুলো জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে, সেগুলোকে আন্দোলনের উপজীব্য করেনি। দ্রব্যমূল্য কমবে, শিক্ষা-চিকিৎসায় সরকারি সহায়তা অনেক বাড়বে, বেকার যুবা-যুবতীদের অর্থবহ বেকার ভাতা দেওয়াসহ কোনো প্রতিশ্রুতিই দেয়নি তারা। তাই খালি কথায় চিড়া ভেজেনি।
● ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক