দশ সমাবেশ শেষে বিএনপির প্রাপ্তির ঝুলিতে যা জমা হলো

সমাবেশগুলোতে বিশালসংখ্যক নেতা-কর্মী উপস্থিত হয়েছেন। শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশেই নেতা-কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমাবেশে এসেছেন।
ছবি : প্রথম আলো

উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা, হামলা, মামলা, আটক, গুলি ও ভয়কে পাশ কাটিয়ে বিএনপি ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশটি শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন করল। মূলত সমাবেশের স্থান নিয়ে বিএনপি ও সরকারের মধ্যে মতভেদের সূত্রপাত। সমাবেশ নয়াপল্টনে করতে চেয়েছিল বিএনপি শুরু থেকেই। নিরাপত্তার কথা বলে সরকার নয়াপল্টনে করতে দিতে রাজি হয়নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করার অনুমতি দিয়েছিল পুলিশ। এ নিয়েই কথা ও মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের শুরু। বিএনপি কার্যালয়ের সমানে পুলিশের গুলিতে একজনের মৃত্যু ও কার্যালয়ে পুলিশি অভিযানের পরও বিএনপি কর্মীরা কোনো সহিংসতার পথ না ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ শেষ করেছে গোলাপবাগে।

সমাবেশ নিয়ে এই পাল্টাপাল্টি অবস্থানে জিতল কে? প্রথমে মনে হয়েছিল পল্টন থেকে সরে গিয়ে বিএনপি ধরাশায়ী হলো। আওয়ামী লীগেরও খুশি হওয়ার কথা যে শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে পল্টন থেকে সরাতে পেরেছে। কিন্তু বিএনপি এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। সমাবেশকে ঘিরে সংঘাত, সহিংসতা হতে পারে—এমন কোনো সিদ্ধান্ত বিএনপি নেয়নি। শুরু থেকেই বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে রাজি হয়নি। বরং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করলে সহিংসতার আশঙ্কা ছিল। গোলাপবাগে সমাবেশের সময়ও ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহড়া দিয়েছে। মহড়া দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের কর্মীরাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ হলে ছাত্রলীগের এসব মহড়া দেওয়া কর্মীদের সঙ্গে সংঘাত শুরু হতে পারত।

পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, বিএনপি বুঝেশুনেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফাঁদে পা দেয়নি। শুরু থেকেই পল্টন নিয়ে অনড় অবস্থান থাকলেও শেষ দিকে গোলাপবাগে যাওয়া বিএনপির জন্য সংঘাত এড়ানোর সহজ পন্থা ছিল। এর ফলে সব বিভাগেই বিশাল বিশাল সমাবেশ করে বিএনপি নিজের শক্তিমত্তা সম্পর্কে দেশি-বিদেশি সবাইকে জানান দিল। এই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের ফাঁদে পা না দিয়ে সংঘাত এড়ানোই বিএনপির প্রাপ্তি। তবে তা একমাত্র নয়।

বিএনপির আরেকটি প্রাপ্তি হচ্ছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্ব। দলের ভেতরে ও বাইরে ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা আছে। দলের অনেকেই তাঁকে অপছন্দ করেন। সরকারের চাপ ও নির্যাতন তো আছেই। এরপরও সমাবেশগুলোতে মার্জিত, ভদ্র ও রুচিশীল বক্তব্য দিয়ে বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কার্যত এখন গৃহবন্দী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে। এই অবস্থায় দলকে সংগঠিত রেখে সামনে টেনে নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়।

ধারাবাহিক বিভাগীয় সমাবেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জন্য অর্থবহ বার্তা দিয়ে গেল। এটা হচ্ছে হরতাল, অবরোধের বাইরে গিয়েও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতি করা সম্ভব। শত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে শান্তিপূর্ণভাবে বিশাল সমাবেশ করা সম্ভব—এটা বিএনপি প্রমাণ করে রাজনীতিতে কিছুটা এগিয়ে গেল। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের প্রবল বাধা ও হামলার মুখেও বিএনপি কোনো সমাবেশ থেকেই পিছু হটেনি।

সমাবেশগুলোতে বিশালসংখ্যক নেতা-কর্মী উপস্থিত হয়েছেন। শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশেই নেতা-কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমাবেশে এসেছেন। দলের অনেক নেতাই হয় জেলে, না হয় শত শত মামলার বোঝা নিয়ে ঘুরছেন। ঢাকায় সমাবেশের ঠিক আগের দিন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ একাধিক কেন্দ্রীয় নেতাকে আটক করে কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। এরপরও বেশ জোরেশোরেই মিছিল নিয়ে কর্মীরা গোলাপবাগে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন গণতন্ত্রের জন্য। অন্তত বিএনপির পক্ষ থেকে এমনটিই দাবি করা হচ্ছে।

চট্টগ্রামে ১২ অক্টোবর বিএনপি প্রথম বিভাগীয় সমাবেশ করেছিল। প্রথম সমাবেশেই বিশাল উপস্থিতি দলটিকে নতুন করে উজ্জীবিত করেছিল। এর ধারাবাহিকতা ছিল পরবর্তী ৯টি সমাবেশ। এসব সমাবেশের অনুমতি দিতে সরকার নানা ধরনের টালবাহানা করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া প্রতিটি সমাবেশের আগে অযথাই পরিবহনমালিকেরা ধর্মঘট আহ্বান করেছেন। এই ধর্মঘটের পক্ষে আবার একগাদা মিথ্যা কথা বলেছেন সরকারের মন্ত্রী ও পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। কিন্তু ধর্মঘট করেও জনসমাগম রোধ করা যায়নি। নানা উপায়ে মানুষ সমাবেশে এসেছেন।

ঢাকাতেও পথে পথে তল্লাশি করেছেন পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা। কিন্তু সমাবেশের স্থান হিসেবে গোলাপবাগ মাঠের নাম ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যেই নেতা-কর্মীতে ভরে গেছে। রাতভর তাঁরা মাঠে অবস্থান করে সরকারবিরোধী স্লোগান দিয়েছেন। খণ্ড খণ্ড মিছিল করেছেন। ঢাকাসহ প্রতিটি বিভাগে সমাবেশের আগে ধরপাকড়, তল্লাশিচৌকি, ধর্মঘট দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করেছে সরকার। কিন্তু এই ভয়ভীতি বিএনপির নেতা-কর্মীদের সমাবেশে আসা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। যত পথ সরকার বন্ধ করছে, তত পথ মানুষ সৃষ্টি করেছে সামাবেশে আসার জন্য।

সমাবেশগুলোতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাইরেও অনেক সাধারণ মানুষ জাতীয় পতাকা নিয়ে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা সংখ্যায় অনেক। বেশ কিছু কারণে সাধারণ মানুষ বিএনপির সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে, ভোটাধিকার হরণ করা। আমাদের দেশে ভোট উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। আমরা পথে-ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে দিনমান রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করি। পাঁচ বছরে একবার এসব আলোচনার পক্ষে-বিপক্ষে সিদ্ধান্ত জানানোর সুযোগ পান নাগরিকেরা। দেশে এখন যেহেতু নির্বাচনব্যবস্থা বলে কিছু নেই, তাই জনসাধারণ ক্ষুব্ধ হয়ে এসব সমাবেশে যোগ দিয়েছে। এর পাশাপাশি সরকারের দুর্নীতি, লাগামহীন অর্থ পাচার, ঋণ জালিয়াতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষকে আরও ক্ষুব্ধ করেছে।

ফলে বিএনপি বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষদের গত কয়েক মাসের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পাশে পেয়েছে। সমাবেশের উপস্থিতির দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সমাজের নিম্নবিত্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা বেশির ভাগ সমাবেশে এসেছেন। তাঁরা কমপক্ষে এক দিন আগে পাটি বা কাঁথা নিয়ে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হয়েছেন। সমাবেশের দু-একদিন আগে এসেই অবস্থান করা, দল বেঁধে রান্না করে খাওয়া, ঘুমানো বিএনপির নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষদের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক সমাবেশকে ঘিরে এ রকম কর্মকাণ্ড নিকট অতীতে তেমন দেখা যায়নি। অনেকেই নিজ খরচে এসব সমাবেশে এসেছেন। এ ধরনের ঘটনা আমাদের রাজনীতিতে বিরল চর্চা। বরং বিরিয়ানি, নানা ধরনের খাবারের প্যাকেট ও নগদ অর্থ দিয়ে সমাবেশে লোক আনতে হয়। এই দিক থেকে বিএনপির এবারের সমাবেশ কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল।

বিএনপির আরেকটি প্রাপ্তি হচ্ছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্ব। দলের ভেতরে ও বাইরে ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা আছে। দলের অনেকেই তাঁকে অপছন্দ করেন। সরকারের চাপ ও নির্যাতন তো আছেই। এরপরও সমাবেশগুলোতে মার্জিত, ভদ্র ও রুচিশীল বক্তব্য দিয়ে বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কার্যত এখন গৃহবন্দী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে। এই অবস্থায় দলকে সংগঠিত রেখে সামনে টেনে নিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য মানুষ মনযোগসহকারে ধৈর্য নিয়ে শুনেছে। খালেদা জিয়ার বা শেখ হাসিনার বাইরে অন্য কারও বক্তব্য শোনার জন্য নেতা-কর্মীরা অপেক্ষা করছেন, এটা আমাদের রাজনীতিতে নতুন ঘটনা। বিভিন্ন সময় বিএনপিকে কোমর ভাঙা, অসংগঠিত, দুর্বল বলে ঠাট্টা-তামাশা করতেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। জোটের বাইরে গিয়ে এককভাবে ধারাবাহিকভাবে বিপুল জন-উপস্থিতি নিয়ে সমাবেশ করে বিএনপি তা ভুল প্রমাণ করেছে।

সমাবেশগুলো থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি পরিষ্কার বার্তা হচ্ছে দমন, নির্যাতন করে কোনোভাবেই মানুষকে আটকে রাখা সম্ভব নয়। বরং পুলিশ দিয়ে হত্যা করে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতক ও কর্তৃত্ববাদী চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে জনমনে।

পল্টনের সহিংসতা নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে সরকারের নির্যাতক ভাবমূর্তিই উল্লেখ করা হয়েছে। হতে পারে এসব পাত্তা দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। কিন্তু বহির্বিশ্বে এসব তথ্য ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যেও নেতিবাচক ধারণা চরমে পৌঁছেছে। পল্টনে সমাবেশ করা নিয়ে সরকার অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সরকারের পক্ষে যুক্তি ছিল বিশাল জনসমাবেশ হবে। পল্টনে নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে। নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকলে তা প্রশমনের দায়িত্ব সরকারের। বিএনপি সমাবেশ করলে জনগণের ভোগান্তি হবে বলে দাবি করে সরকার নিজেই পুলিশ দিয়ে পল্টনের রাস্তা আটকে রাখল তিন দিন। সেখানে পুলিশের ঘেরাটোপের মধ্যে আওয়ামী লীগের কর্মীরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে মিছিল করলেন।

ধারাবাহিকভাবে শান্তিপূর্ণ ও সফল সমাবেশ করার মধ্য দিয়ে বিএনপির নতুন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা পেল।

  • ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক