গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঢুকলে একটা শিশুর ছবি বারবার সামনে আসছিল। ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক। মুখে একরাশ হাসি। মায়াবী চোখজোড়া অপলক তাকিয়ে আছে। পরনে বেগুনি রঙের জামা। ফুটফুটে সুন্দর শিশু মুনতাহা আক্তারের এই ছবি গত কয়েকদিনে অসংখ্যবার দেখা হয়ে গেছে আমাদের।
পাঁচ বছর বয়সী এ শিশুর খোঁজ চায় সবাই। আহারে কোথায় হারাল বাচ্চাটা? প্রতিদিন কত বাচ্চা হারিয়ে যায়, আবার ফিরেও পাওয়া যায়—তেমনই কোনো ঘটনাই মনে হচ্ছিল। ফলে ময়মনসিংহে কোনো স্টেশনে শুয়ে থাকা কোনো বাচ্চাকে মুনতাহার মতো মনে হয়, তাও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। সবার মধ্যে একটি আশা সঞ্চার হলেও তা আর সত্য হয় না।
একেকটা দিন যায় মুনতাহা হয়ে ওঠে সবার বাচ্চা। আদরের সন্তানের খোঁজে সবাই যেন হয়ে ওঠেন মুনতাহার পাগলপারা মা–বাবা। ফলে মুনতাহার সন্ধান দিতে পারলে একেকজন থেকে আসে পুরস্কারের ঘোষণা। কেউ ঘোষণা দেন, স্বর্ণের চেইন উপহার দেয়া হবে, কেউ লাখ টাকা, কেউ দশ হাজার টাকা, কেউ দেবেন চাকরি।
সামাজিক একাত্মতার কী অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ। সবারই একটি আশা, মুনতাহা ফিরে আসুক। কিন্তু সে ফিরে আসলেও যেভাবে এসেছে, তা সবাইকে স্তব্ধই করে দেয়। গোটা দেশের মানুষ মুনতাহার সন্ধান করে বেড়ালেও বাড়ির পাশের ডোবায় তার লাশ পুঁতে রাখা হয়েছিল।
মুনতাহার বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামে। এক ওয়াজ মাহফিল থেকে ৩ নভেম্বর সকালে বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরে সে বাইরে খেলতে যায়। পরে আর খোঁজ মেলেনি। শিশুটি নিখোঁজের পর থেকে পরিবার দাবি করে আসছিল, পরিকল্পিতভাবে মুনতাহাকে অপহরণ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় সন্দেহভাজন এক তরুণীকে আটক করা হয়, যিনি মুনতাহাকে প্রাইভেটও পড়াতেন। তখন ওই তরুণীর মা ঘটনাকে অন্য রূপ দিতে লাশ ডোবা থেকে তুলে রোববার ভোরে (১০ নভেম্বর) শিশুটির বাড়ির পাশে একটি পুকুরে ফেলে আসতে যান। তবে পথে স্থানীয় লোকজনের হাতে আটক হন ওই নারী। সেসময় উদ্ধার হয় মুনতাহার মরদেহ। স্থানীয় বিক্ষুব্ধ লোকজন ওই নারীর বাড়ি ভাঙচুর করে তাতে আগুন দেন। পরে এসে পুলিশ তাঁদের নিবৃত্ত করে।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কোনো বিরোধে মুনতাহাকে হত্যা করা হয়েছে। বড়দের বিবাদে প্রতিশোধের বলি হতে হলো একটি শিশুকে। আমাদের সন্তানেরা কতভাবেই না নিরাপত্তাহীন!
রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিনিধিরা প্রতিনিয়ত আমাদের নীতি–নৈতিকতার কথা শোনান। সরকারের ব্যক্তিবর্গ শোনান আইন ও বিচারের কথা। তবু কেন রাজনের পর রাকিব, রাকিবের পর আয়াত, আয়াতের পর মুনতাহাদের লাশ আমাদের দেখতে হয়? আর কত শিশুকে এভাবে ‘প্রতীক’ হয়ে ওঠতে হবে তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতার জানান দিতে?
ভোর বেলায় দূরপাল্লার বাসে করে ঢাকায় প্রবেশ করছিলাম। তখন মাত্র আলো ফুটেছে চারদিকে। ঘুমঘুম ভাবটাও কাটা শুরু করল। ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবসকে ঘিরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কর্মসূচির ঘোষণা আর ফ্যাসিবাদী শক্তিকে মোকাবিলায় ছাত্র–জনতার প্রতিরোধের ডাক, এ নিয়ে নানা উত্তেজনা ছড়িয়েছে গত সন্ধ্যা থেকে। পরিস্থিতি কী বোঝার জন্য ফেসবুকে ঢোকা হলো। টাইমলাইনজুড়ে তখনও মুনতাহার ছবি। এড়িয়ে যেতে চাইলাম, কারণ পাঁচ দিনেও যেহেতু খোঁজ পাওয়া যায়নি, খারাপ কিছু ঘটার শঙ্কাও বাড়ছিল। সেটিই সত্য হলো। স্বাভাবিকভাবে মনটা বিষাদময় হয়ে গেল। নতুন একটা দিন শুরু হলো ফুলের মতো একটা শিশুর নির্মম মৃত্যুর খবরের স্বাক্ষী হয়ে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখছিলাম, এক সন্তান হারানোর বেদনায় শত শত মা-বাবার মন কেঁদে ওঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই যে কারও প্রশ্ন জাগে খুন, ছিনতাই, ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন, শিশু নির্যাতন, অপহরণ—সমাজকে এসব অপরাধমুক্ত করতে যে আইনি শাসন দরকার, বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা থাকা দরকার, তা কি কখনো ছিল এ দেশে?
গত এক যুগে পরিস্থিতি ছিল আরও শোচণীয়। তখন ছিল পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম ক্ষমতাচর্চার নামে আস্ফালন, আর এখন ‘ক্ষমতাহীন’, তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি আস্থাহীন। আর বিচার ব্যবস্থার কথা কী বলব? ফলে গণতন্ত্র বা ডেমোক্র্যাসির জায়গায় এখন চলে এসেছে মবোক্র্যাসি বা মবের মুল্লুক নামে শব্দবন্ধ। সামাজিক অপরাধ মোকাবিলায় মানুষ নিজেই হয়ে যাচ্ছে অপরাধী। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বা অপরাধপ্রবণতা দূরীকরণ দূর অস্তই থেকে যায়।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুসারে, জানুয়ারি–মার্চ পর্যন্ত ১৩৯ জন শিশু হত্যার শিকার হয়, নির্যাতনের শিকার ১৮৬ জন; এপ্রিল–জুন পর্যন্ত হত্যার শিকার ১০০ জন, নির্যাতনের শিকার ২০৬ জন; জুলাই–সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হত্যার ২১৫ জন, নির্যাতনের শিকার ১২৯ জন। শেষ তিন মাসে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নিহত হয় ১২৬ শিশু–কিশোর। ধর্ষণের শিকার মেয়ে ও ছেলে শিশুর সংখ্যা প্রতি ত্রৈমাসিকে অর্ধশতাধিক।
এ পরিসংখ্যান বলছে মুনতাহা আসলে একজন নয়। অসংখ্য মুনতাহা মানুষের নির্মম ও নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে, যাদের নামও আমরা জানছি না, জানলেও মনে রাখছি না। মুনতাহা আসলে এসব শিশুরই প্রতীকি নাম হয়ে ওঠে।
দুই বছর আগে এমনই এক প্রতীকি নাম হয়ে ওঠেছিল শিশু আয়াত। চট্টগ্রামে এ শিশু দশ দিন ধরে নিখোঁজ থাকার পর জানা যায় মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করার পর তাকে হত্যা করে লাশ ছয় টুকরো করে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিল প্রতিবেশী এক যুবক।
তাঁরও আগে সিলেটের শিশু রাজন হত্যা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তাকে হত্যার ভিডিওর দৃশ্য আন্তর্জাতিক মিডিয়াতেও শিরোনাম হয়েছিল। সিলেটের পৈশাচিকভাবে আরেকটা শিশু হত্যার ঘটনা কোনোভাবে ভুলবার নয়। ওয়ার্কশপে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেয়া কমপ্রেসার মেশিনের মাধ্যমে মলদ্বারে হাওয়া ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল শিশু রাকিবকে।
সীমান্তহত্যায় কত কত মানুষ মারা গেল আমরা মনে রাখি ফেলানী খাতুন বা স্বর্ণা দাশের নাম। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে প্রতি বছর কয়েক শ শিশু মারা যায়। তার মধ্যে আমরা মনে রাখি সিরীয় শরণার্থী শিশু আয়লান কুর্দির কথা। গাজায় ইসরায়েলের হামলায় হাজার হাজার শিশু নিহত হলো। আমরা মনে রাখতে পারি গুটি কয়েকের নাম, যার মধ্যে আছে দশ বছর বয়সী রাশা, যে কীনা মৃত্যুর আগে অসিয়ত করে যায়—তার খেলনা, পুতির মালা কাকে কাকে ভাগ করে দিতে হবে। তাদের মাধ্যমে আমরা পড়ে নিই আসলে নিষ্ঠুরতা ও সহিংসতার শিকার তামাম শিশুর করূণ গল্প। যেসব গল্পের মাধ্যমে তারা আমাদের মধ্যে আজীবন জিন্দা থেকে যায়।
মুনতাহাও এ দেশের নির্যাতনের শিকার তামাম শিশুর কথাই বলে গেল যেন। রাষ্ট্রিক ও রাজনৈতিক বিবিধ পটপরিবর্তন ও উত্তেজনার ভেতর তাদের নির্মম গল্পগুলো হারিয়ে যেতে বসেছিল, সেটিই যেন মনে করিয়ে দিল মুনতাহা আমাদের।
রিয়া গোপ, আব্দুল আহাদ, জাবির ইব্রাহিম, রাকিব হাসান, হোসেন মিয়া, তাহমিদ ভূইয়াদের মতো কত শিশুও তো ফ্যাসিবাদী শক্তির গুলিতে প্রাণ দিল তিন মাস আগে। তাতেও কি প্রশ্ন জাগে, আমরা কবে আমাদের শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ রাষ্ট্র গড়তে পারব।
রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিনিধিরা প্রতিনিয়ত আমাদের নীতি–নৈতিকতার কথা শোনান। সরকারের ব্যক্তিবর্গ শোনান আইন ও বিচারের কথা। তবু কেন রাজনের পর রাকিব, রাকিবের পর আয়াত, আয়াতের পর মুনতাহাদের লাশ আমাদের দেখতে হয়? আর কত শিশুকে এভাবে ‘প্রতীক’ হয়ে ওঠতে হবে তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতার জানান দিতে?
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com