এ কী করলেন রাফসান দ্য ছোট ভাই! দামি বা বিলাসবহুল গাড়ি দিয়ে মা-বাবাকে চমকে দিয়েছেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে তাঁদের চোখে খুশির অশ্রু। রাফসানের মতো কয়জন তরুণই–বা এমনটি করতে পারেন? তেমন নজিরই কি আছে?
রাফসানের মূল নাম ইফতেখার রাফসান। যাঁর বয়স ২৬ বছর। তাঁর বয়সী তরুণদের অনেকে এখনো সেশনজটে আটকে পড়ে পড়াশোনাই শেষ করতে পারেননি যেখানে, টিউশনি করে অনেককে পরিবারে টাকাও পাঠাতে হয়, অনেকে চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে হতাশাগ্রস্ত, অনেকে বিসিএসের স্বপ্ন দেখে এখন গ্রামে গিয়ে প্রাথমিকের মাস্টারিকেই বেছে নিয়েছেন, তাঁদের পক্ষে মা-বাবাকে এভাবে চমকে দেওয়া তো দূরে থাক, স্বপ্ন দেখাও দুঃসাহসী ব্যাপার নয় কি?
কিন্তু রাফসান পারলে কেন তাঁরা পারবেন না? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে কী লাভ হলো তাঁদের? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনার শেষ নেই।
রাফসান দ্য ছোট ভাই—সময়ের আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর বা আধেয় নির্মাতা। সে সুবাদে হয়ে উঠেছেন একজন ইনফ্লুয়েন্সারও। কোনো না কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন কিন্তু জেন–জির এই তরুণকে চেনেন না, এমন মানুষ খুব কমই আছেন।
বড়–ছোট, ছেলে-বুড়ো অনেকেরই প্রিয় চরিত্র এই রাফসান। অল্প বয়সের ছেলেমানুষির সরল অভিব্যক্তি ও সংকোচহীনভাবে সেসবের উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে রাফসান কয়েক বছরের মধ্যে পৌঁছে গেছেন লাখ লাখ মানুষের কাছে।
কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করা বা কারও সঙ্গে তর্কবিতর্কে বা উত্তপ্ত কোনো ইস্যুতে না জড়ানোর ব্যাপারে বেশি সাবধানীই বলা চলে তাঁকে। অন্যদের ছাড়িয়ে যাওয়ার এটিও তাঁর বড় একটি কারণ।
নানাভাবেই তিনি আলোচনায় থাকেন। যেমন লুঙ্গি পরে দামি রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে, রাস্তায় খাবার বা পানি বিতরণ করে, বন্যার্তদের মধ্য ত্রাণ বিতরণ করে, ভয়াবহ তাপপ্রবাহের সময় ১০ লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়ে, নিজের পানীয় পণ্য বাজারে ছেড়ে, ভক্তদের দামি আইফোন উপহার দিয়ে, হেলিকপ্টারে চড়ে এভারেস্টে গিয়ে ইত্যাদি ঘটনায়। প্রতিটি ঘটনা মূলত তাঁর একেকটি কনটেন্ট। ফলে সেখানে যুক্ত হয়ে পড়েন তাঁর লাখ লাখ অনুসারীও।
সর্বশেষ রাফসান আলোচনায় এখন মা-বাবাকে গাড়ি উপহার দিয়ে। যে সে গাড়ি নয়। জার্মান কোম্পানি আউডির গাড়ি। ইউরোপ-আমেরিকায়ও এ গাড়ি বিলাসবহুল হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশেও খুব কম মানুষের কাছে এ গাড়ি আছে।
দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজারের ওপরে ব্যক্তিগত গাড়ি আমদানি হয়। সেখানে প্রথম আলোর ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদন বলছে, গত পাঁচ বছরে আউডি গাড়ি আমদানি হয়েছে ২৯৭টি। ২০২২ সালে আউডি গাড়ি আনা হয়েছে মাত্র ৬৯টি।
ট্যাক্সনিউজ বিডি ডটকম নামে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে এনবিআর সূত্রে বলছে, বিআরটিএর সরবরাহ করা তালিকায় আউডি গাড়ি ব্যবহারকারী ব্যক্তি মাত্র ২৭ জন।
এ থেকেই ধারণা করা যায়, শুধু বড়লোক হলেই আউডি গাড়ি কেনা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ, দেশের বাজারে আউডি গাড়ি বিক্রি হচ্ছে দুই কোটি টাকার ওপরে। ধরে নিই, সেটি রিকন্ডশন বা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি। এরপরেও কিন্তু সেটির দাম কম হওয়ার কথা না।
তার মানে রাফসান দ্য ছোট ভাই সেই গাড়ি কেনার মতো সামর্থ্যবান হয়েছেন, তা–ও ফুড বা ট্রাভেল ভ্লগিং করে, মানে কনটেন্ট বানিয়ে, এটি কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।
সবাইকে ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’ হতে হবে—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দুনিয়া মানুষের মধ্যে এমন একটি ফেনোমেনা বা প্রপঞ্চ তৈরি করেছে।
শুধু কনটেন্ট বা আধেয় নির্মাণ করলেই হবে না, সেটি পৌঁছে দিতে হবে হাজার হাজার বা লাখো মানুষের কাছে। কারণ, এটি এখন অর্থ উপার্জনের বড় মাধ্যম। যত বেশি মানুষ দেখবে, তত বেশি অর্থ আয় হবে। আবার শুধু অর্থও নয়, জনপ্রিয়তার সাফল্যও এখানে বড় হয়ে উঠেছে।
ফলে মানুষকে আকৃষ্ট করতে বৈচিত্র্যময় ও সৃজনশীল বিষয় যেমন এখানে উঠে আসছে; আবার অদ্ভুত, অশ্লীল, ধর্মীয়-অধর্মীয়, কদর্য ও প্রতারণামূলক বিষয়েও ভরে উঠছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। অনেকেরই এখন হাজার হাজার বা লাখ লাখ ফলোয়ার। কিন্তু সবাই কি রাফসান দ্য ছোট ভাই হতে পেরেছেন?
রাফসানের ভিডিওগুলো দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, সামর্থ্যবান কোনো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে অনেক কষ্ট করে উঠে এসেছেন তিনি। আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে তাঁকে দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও ধৈর্যের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মা-বাবাকে গাড়ি উপহার দেওয়ার ভিডিওতেই বোঝা যায়, তিনি উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারেরই সন্তান। এর আগে তাদের তিনটি ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল। ফলে বলাই যায়, তিনি সমাজের বিশেষ সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তদের একজন।
এবার তাঁর সঙ্গে তুলনা করুন তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থীর; যাঁরা খেয়ে না খেয়ে, গণরুমে পড়ে থেকে; রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে টিউশনি করিয়ে পড়াশোনা করছেন বা শেষ করছেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন আর শুধু বড়লোকের সন্তানেরা পড়েন না, সাধারণ মধ্যবিত্তের পরিবারের অনেকেই সেখানে পড়েন এবং অনেক কষ্ট করেই।
পরিবারের প্রত্যাশা পূরণ ও নিজের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চাপ, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া, বাস্তবতাহীন শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনা করা, চাকরির বাজারের দুরবস্থার মধ্যে ‘সোনার হরিণ’ সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে প্রতিদিন ভোরে শত শত শিক্ষার্থী কেন ভিড় করবেন না?
তবে এটি ঠিক, শুধু চাকরিমুখী না হয়ে নিজের মেধা ও সৃজনশীলতা নিয়ে অনেকে সংগ্রাম করে থাকেন নিজে কিছু একটা করতে। এতে সফলতার ঝুঁকি তো অবশ্যই থাকে, এরপরও অনেকে সে পথই বেছে নেন নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য। অনেকে সফল হন, সবাই নন।
রাফসান দ্য ছোট ভাইকে প্রশংসা করা যায় এই জায়গায়, তিনি স্বপ্নপূরণে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, দক্ষতা তৈরি করেছেন এবং ঝুঁকি নেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন। এর জন্য অবশ্যই বড় ভূমিকা রেখেছে পরিবারের সহযোগিতা। নিজে কিছু একটা করতে গেলে সামাজিক ও পারিবারিক হীনম্মন্যতা পেয়ে বসা তো এখানকার কালচার। একটি ভালো রেজাল্ট বা ভালো চাকরি না পাওয়া মানে এখানে ‘তোকে দিয়ে কিছুই হবে না বা কিছুই হলো না’।
সেদিক দিয়ে রাফসানকে ভাগ্যবানই বলতে হবে। তবে তিনি অন্য তরুণদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মানদণ্ড হতে পারেন কি? আমরা কে না জানি, এক্সেপশন ইজ নট অ্যান এক্সাম্পল।
আরও একটি বিষয় হচ্ছে পড়াশোনা করা বা শিক্ষিত হওয়ার উদ্দেশ্য কি শুধু বড়লোক বা বিত্তবান হওয়া? অর্থবিত্তের মালিক হওয়াই কি শুধু প্রতিষ্ঠিত হওয়া বোঝায়? সমাজে কেউ চিকিৎসক হবেন, কেউ শিক্ষক, কেউ ব্যাংকার, কেউ সরকারি চাকরিজীবী হবেন। সবাই খুব বেশি হয়তো অর্থবিত্তের মালিক হবেন না কিন্তু পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য সারা জীবন অবদান রেখে যাবেন।
রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের কনটেন্টগুলো আমাদের বিনোদন দেয়, এটি তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে তিনি অল্প বয়সে যে বিত্তময় ও চটকদারি জীবন পেয়েছেন, শুধু কনটেন্ট বানিয়ে সেটি কি তিনি সারা জীবন ধরে রাখতে পারবেন?
রাফসানের আগেও অল্প সময়ের মধ্যে অনেকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা এখন কোথায়? এখানে আয়মান সাদিকের কথা আলাদাভাবে বলতে হবে। কারণ, তাঁর কনটেন্ট বানানো বিনোদন দেওয়ার জন্য ছিল না। এখানে বড় উপাদান হচ্ছে শিক্ষা। যেটি তাঁকে টেন মিনিটস স্কুলের মতো একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি করতে সহায়তা করেছে। যে স্কুলের পাঠসহায়তা নিয়ে দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েও ভালো জায়গায় উচ্চশিক্ষা নেওয়া সুযোগ পেয়েছেন, এমন উদাহরণও আছে।
ফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটরের পেশা বা জনপ্রিয়তার ‘আয়ু’ আসলে কত দিন? রাফসান নিশ্চয়ই অনেক তরুণের জন্য ‘সাময়িক অনুপ্রেরণা’ হবেন। তবে সবাইকে তাঁর মতো হতে হবে, তাঁকে দেখে ভাবতে হবে—তিনি পারলে অন্যরা কেন পারেন না, এমন আলোচনা মূল্যহীন।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com