মতামত

খাদের কিনারে ইরান

ইরানের তরুণ প্রজন্ম সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে
ছবি: এএফপি

প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরে ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র অভ্যন্তরীণ ও বিদেশনীতির অসংখ্য চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করেছে। কিন্তু হিজাব না পরায় আটক হওয়া ২২ বছরের তরুণী মাসা আমিনির থানা হেফাজতে মৃত্যুর পর গত মাসে দেশজুড়ে যে জনবিক্ষোভ শুরু হয়, তা এখন সরকারের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হচ্ছে ইরান তার সবচেয়ে বড় সংকটের কবলে পড়ে গেছে।

যখন ইসলামি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির পশ্চিমাপন্থী রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনিকে দেশের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, তখন পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা এই ধর্মতান্ত্রিক শাসন দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কিছু বিশ্লেষক যুক্তি দিয়েছিলেন, ইরানের মতো একটি অত্যাধুনিক দেশ চালানোর জন্য ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা থাকতে পারে না।

কিন্তু খোমেনির বাস্তববাদী (ইজতিহাদি) দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একটি যুদ্ধাত্মক (জিহাদি) পন্থার মিশ্রণ ঘটিয়ে ইরানের শাসকেরা সমস্ত অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন। ৮৩ বছর বয়সী আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি আদর্শিক এবং ব্যবহারিক বিবেচনার ভারসাম্য বিষয়ে পূর্বসূরি আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনিকে অনুসরণ করে আসছেন।

সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে খামেনি এমন একটি মর্যাদা উপভোগ করেন, যা তাঁকে প্রেসিডেন্ট এবং অন্য নির্বাচিত কর্মকর্তাদের ওপর চূড়ান্ত খবরদারি করার এখতিয়ার দেয়। খামেনি যখন তাঁর নিজের কর্তৃত্ব এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রধান নিয়ামক, বিশেষ করে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের জন্য গুরুতর হুমকি অনুভব করেন, একমাত্র তখনই তিনি অভ্যন্তরীণ সংস্কারে সম্মত হন এবং পররাষ্ট্রনীতিতে বাস্তববাদ প্রদর্শন করে থাকেন; যেমনটি তিনি ২০১৫ সালে ইরান পারমাণবিক চুক্তিকে সমর্থন করার মাধ্যমে করেছিলেন।

এটিকে ইরান সরকারের পক্ষ থেকে ‘বীরত্বপূর্ণ নমনীয়তা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু খামেনি অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে লৌহমুষ্টিতে সব নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। তবে তিনি যা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, তা হলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইরানিদের একটি নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে, যাদের ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের চেতনা বা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতি কোনো টান নেই। বিশেষ করে যখন সেই শাসনব্যবস্থা তাদের ভালোভাবে নাগরিক সেবা দিতে পারেনি, তখন তারা যৌক্তিকভাবেই সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ইরানের বিপুল পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও, বিশেষ করে দেশটির তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুত থাকার পরও প্রায় ৪০ শতাংশ ইরানি দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।

কয়েক দশকের রাজনৈতিক নিপীড়ন, ব্যাপক দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ধীরে ধীরে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করে দিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি ও পররাষ্ট্রনীতির জটিলতা, মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা এবং বেশ কয়েকটি ব্যয়বহুল আঞ্চলিক সংঘাতে ইরানের জড়িত থাকাসহ নানা বিষয় অনেক ইরানিকে এতটাই হতাশ করেছে যে দেশব্যাপী গণ-অভ্যুত্থান এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।

বর্তমান বিক্ষোভগুলো দেশটিতে ইতিপূর্বে সংঘটিত জনপ্রিয় আন্দোলন ও অস্থিরতার তরঙ্গগুলোকে অনুসরণ করছে মাত্র। এর আগের আন্দোলনগুলো সরকার সফলভাবে দমন করেছিল, বিশেষত ২০০৯ সালের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরে যে গ্রিন মুভমেন্ট হয়েছিল, তা সরকার কঠোরভাবে দমন করেছিল। দেশটিতে ইসলামি ব্যবস্থা চালু করা যে কট্টরপন্থীরা আজ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন, তাঁরা ভালো করে জানেন, এই শাসনের পতন হলে তাঁরা তার সঙ্গে ভেসে যাবেন। তাই তাঁরা সংঘবদ্ধ আন্দোলনের প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ামাত্রই দাঙ্গা পুলিশকে ডাকে।

কিন্তু সরকার হয়তো অনির্দিষ্টকালের জন্য বিক্ষোভ দমন করে রাখতে পারবে না। কারণ, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ নাগরিক হলো তরুণ বয়সের এবং এই তরুণেরা শাসকদের বিপ্লবী বাগ্মিতা এবং ধর্মতান্ত্রিক হুকুমে বিরক্ত। তারা অধিকার, স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা, উন্নত জীবনযাত্রা এবং তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার চায়। ক্ষমতাসীন ধর্মীয় নেতা এবং তাদের সমর্থকেরা অর্থনীতির শৃঙ্খলায় যে অব্যবস্থাপনার সৃষ্টি করেছে, তা অধিকাংশ নাগরিককে ক্রমবর্ধমানভাবে হতাশাগ্রস্ত, মরিয়া, ভীত এবং ক্ষুব্ধ করছে। চলমান আন্দোলনে বিদ্যমান ইসলামি শাসনব্যবস্থা উৎখাতের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু ইরানিদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ইতিহাস রয়েছে।

ক্ষমতাসীনদের শাসনকে স্থিতিশীল করতে খামেনি এবং তার সমর্থকদের অবশ্যই দমনের পথ পরিবর্তন করতে হবে এবং সংস্কারবাদী দলগুলোকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। এক দশক আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির নেতৃত্বে ইরানের সংস্কারকেরা ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে আরও সহনশীল ও মানবিক করার চেষ্টা করেছিলেন।

কিন্তু কট্টরপন্থীরা, যাঁরা এখনো ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা তাঁদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। ইরানে আজ যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তা থেকে বোঝা যায়, কেন কাঠামোগত সংস্কার জরুরি এবং কেন এই সময়ে ধর্মীয় নেতাদের শাসন রক্ষা ধরে রাখা কঠিনতর হবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  •  আমিন সেইকাল ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক