সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, শিশুশ্রম এবং শিশুদের শ্রম নিয়ে মূল্যবোধ সৃষ্টির প্রয়াসকে আমরা একই মনে করে গুলিয়ে ফেলছি। তাই শিশুশ্রম এবং শিশুদের শ্রম নিয়ে কী ধরনের মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠা উচিত, সে বিষয়ে আলোচনা করার সময় এসেছে।
শিশুশ্রম বলতে আমরা বুঝি শিশু তার শৈশবের আনন্দঘন পরিবেশ রেখে খেলাধুলা না করে, তার অপার সম্ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে, শারীরিক–মানসিক পরিশ্রমের মাধ্যমে যদি অর্থ উপার্জন করে। এ ক্ষেত্রে শিশুর অগাধ সম্ভাবনা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতীয় শিশু আইন, ২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের মজুরির বিনিময়ে কাজে নিয়োজিত করা হলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে।
শিশুশ্রম একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা, যা একটি দেশের উন্নয়নকে পশ্চাৎমুখী করে। একটি নির্দিষ্ট সময় পরে দেখা যাবে, শিশুর কর্মদক্ষতা অল্প বয়সে হারিয়ে যাচ্ছে এবং যখন প্রকৃত অর্থে তার কাজ করার কথা, তখন সে শারীরিক ও মানসিকভাবে অকেজো হয়ে জাতির জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে।
অপর দিকে শিশুর শ্রমের প্রতি মূল্যবোধ জাগ্রত করার নিমিত্তে শিশুদের দিয়ে নিত্যদিনের কাজ করাকে আমরা শিশুশ্রমের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছি। একদিকে যেমন শিশুশ্রমকে সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে, অন্যদিকে তেমনি শিশুদের পরিবার ও বিদ্যালয় থেকে শ্রমের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করতে হবে। শ্রমের মূল্য নামক রচনা পড়েই শিশু কোনো স্বীকৃত কাজ ছোট মনে করবে না, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
এ ক্ষেত্রে কবিগুরুর প্রবন্ধের সেই বিখ্যাত শিক্ষাদর্শন এখনো উল্লেখ্য, ‘যতটুকু অত্যাবশ্যক কেবল তাহারই মধ্যে কারারুদ্ধ হইয়া থাকা মানবজীবনের ধর্ম নহে। আমরা কিয়ৎপরিমাণে আবশ্যক-শৃঙ্খলে বদ্ধ হইয়া থাকি এবং কিয়ৎপরিমাণে স্বাধীন। আমাদের দেহ সাড়ে তিন হাতের মধ্যে বদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঠিক সেই সাড়ে তিন হাত পরিমাণ গৃহ নির্মাণ করিলে চলে না। স্বাধীন চলাফেরার জন্য অনেকখানি স্থান রাখা আবশ্যক, নতুবা আমাদের স্বাস্থ্য এবং আনন্দের ব্যাঘাত হয়। শিক্ষা সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। যতটুকু কেবলমাত্র শিক্ষা, অর্থাৎ অত্যাবশ্যক, তাহারই মধ্যে শিশুদিগকে একান্ত নিবদ্ধ রাখিলে কখনোই তাহাদের মন যথেষ্ট পরিমাণে বাড়িতে পারে না। অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীন পাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করিয়া মানুষ হইতে পারে না বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।’ তাই শ্রমের মূল্য শুধু খাতা–কলমে না শিখিয়ে বরং তাকে হাতে–কলমে কাজ করার মাধ্যমে বিশ্বাস করাতে হবে যে কোনো কাজই ছোট নয়।
শিশুর পরিবারের পর তার সামাজিকীকরণে বিদ্যালয়ের ভূমিকাই মুখ্য। তাই প্রাক্–প্রাথমিক আর প্রাথমিক শিক্ষার পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ মতে, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি এমন হওয়া উচিত যেন তা শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা অর্জন এবং মানবিক মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়; আত্মকর্মসংস্থান ও শ্রমের প্রতি শিক্ষার্থী যেন আগ্রহী হয় এবং শ্রমের মর্যাদা তারা যেন উপলব্ধি করতে পারে। তা ছাড়া বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তরের যে ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম একটি প্রান্তিক যোগ্যতা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা যেন নিজের কাজ নিজে করতে পারে এবং তারা যেন শ্রমের মর্যাদা দিতে পারে।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এবং প্রান্তিক যোগ্যতা পূরণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে চারু ও কারুকলা, সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা নামক নতুন তিন ধরনের বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন শিক্ষাক্রমের সংগীত বিষয়ের ভূমিকাতে উল্লেখ রয়েছে, ‘সুকুমার শিল্পচর্চার সুযোগ সৃষ্টির নিমিত্তে প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে নতুন করে সংগীত বিষয়টি আনয়ন করা হয়েছে। সুর আর ছন্দের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা গানের বাণী ছোটদের মনকে সচেতন করে তুলবে এবং তাদের মধ্যে সৃজনশীলতা, সুকুমারবৃত্তি ও নান্দনিক বোধের উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করবে। সেই সঙ্গে শিশুমনে নৈতিক ও সামাজিক গুণাবলি অর্জনের মানসিকতা সৃষ্টি করবে এবং শ্রমের মর্যাদা উপলব্ধি করতে ও আত্মমর্যাদাবোধ সৃষ্টিতে সাহায্য করবে।
এ ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণিতে আবদুল লতিফ রচিত এবং সুরারোপিত “নিজের হাতে কাজ কর” গানটি শিক্ষার্থীদের শ্রমের প্রতি ইতিবাচক মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে।’ তা ছাড়া ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ নামক বিষয়টিতে সব পেশাকে গুরুত্ব দেওয়া ও কায়িক শ্রমের প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য বিভিন্ন অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি শিখন শেখানো প্রক্রিয়ায় সরকার কর্তৃক প্রণীত শিক্ষাক্রমকে প্রভাবিত করে (জিরক্স এবং ম্যাকলার্ন, ১৯৮৯)। তাই শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে শিশুশিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে যত কিছুই থাকুক না কেন, শিক্ষকদের শ্রম নিয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না ঘটালে, শ্রমের প্রতি ইতিবাচক মূল্যবোধ সৃষ্টি করার জন্য যতই নীতি নির্ধারণ করা হোক না কেন, তা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোই হবে।
মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি করার প্রয়াসে চাহিদাভিত্তিক যুগোপযোগী পৌনঃপুনিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধন করার ওপরে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ গুরুত্ব আরোপ করেছে। সুশিক্ষায় প্রশিক্ষিত একজন শিক্ষক তাঁর শিখন শেখানো কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির আলোকে শিক্ষার্থীদের শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হিসেবে গড়ে তুলে ভবিষ্যৎ স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে প্রত্যক্ষ অবদান রাখবে, সেই আশায় পুরো দেশ।
আফরোজা ইসলাম ইনস্ট্রাক্টর (সাধারণ), প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, মানিকগঞ্জ