আইনি সহায়তার যেসব প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

‘ন্যায়বিচার বলে কিছু নেই, যদি না আপনি অর্থ দিয়ে তা কিনতে পারেন।’
মনে হতে পারে, এটা আমাদের বাংলাদেশের মতো বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের সূচকের মানদণ্ডে পিছিয়ে থাকা দেশের হতাশাগ্রস্ত কোনো বিচারপ্রার্থীর হতাশার করুণ বহিঃপ্রকাশ।  কিন্তু বাস্তবে এটা যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা–সংক্রান্ত এক গবেষণায় উদ্ধৃত একটি উক্তি।

ইয়েল ল জার্নালের এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, একজন নির্দোষ দরিদ্রের চেয়ে একজন দোষী ধনী তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকেন। সবচেয়ে কঠোরতম সাজাগুলো সাধারণত তাঁরা পান, যাঁদের আইনজীবীরা তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে থাকেন; তাঁরা নন যাঁরা সবচেয়ে নিকৃষ্টতম অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত।

বলা হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রে সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন আইনের উপরিকাঠামোগত সংস্কার কিংবা ভবন নির্মাণের মতো ভৌত অবকাঠামোর জন্য যত অর্থ ব্যয় হয়, তার তুলনায় খুব সামান্য অর্থই ব্যয় হয় অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের আইনি আশ্রয় পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী দেশে সাধারণ বিচারপ্রার্থীর আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের এ ধরনের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা থেকে উপলব্ধি করা যায়, সর্বসাধারণের দোরগোড়ায় আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ পৌঁছানো কতটা দুরূহ। কিন্তু একটি ধনী দেশের তুলনামূলক হতাশাব্যঞ্জক চিত্র থেকেও আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কিছু থাকতে পারে।

সর্বসাধারণের দোরগোড়ায় আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ অবারিত করার লক্ষ্যে আমাদের জাতীয় সংসদ ২০০০ সালে আইনি সহায়তা বিধান আইন পাশ করেছে। এই আইনের অধীন বিভিন্ন সময়ে কিছু প্রবিধানমালা, বিধিমালা এবং নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। শুধু জাতীয় পর্যায়ে বা সুপ্রিম কোর্টে নয়, সারা দেশের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়েও আইনি সহায়তা প্রদান কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ মতামত এবং অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে কারা এই আইনের অধীনে আইনি সহায়তা পাওয়ার যোগ্য, সে ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার করা হয়েছে।  এটা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে শুধু বার্ষিক আয়ের ভিত্তিতে নয় বরং বিভিন্ন আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে বর্তমানে আইনি সহায়তা লাভের অধিকারের বিধান রাখা হয়েছে, যা আগের চেয়ে সুচিন্তিত।

বর্তমানে এই আইনের আওতায় যেসব আইনজীবী আইনি সহায়তা দেবেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতার বিধান শিথিল করার কথা ভাবা যেতে পারে। অনেকে বলতে পারেন, স্বল্প অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইনজীবীরা হয়তো তাঁদের মক্কেলের জন্য যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা করতে সক্ষম না–ও হতে পারেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত, অনেক সময় একজন নবীন আইনজীবীর মামলায় লড়ার এবং জেতার জন্য যে প্রচেষ্টা থাকে, সেটি অনেক অভিজ্ঞ আইনজীবীর না–ও থাকতে পারে।

বাংলাদেশের বর্তমান আইনি সহায়তা প্রদানের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো, এখানে আইনি সহায়তা প্রদানকারী আইনজীবীদের জন্য শুধু নামমাত্র পারিশ্রমিকভিত্তিক পুরস্কারের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতিসহ অন্য বিচারপতিরা এবং অ্যাটর্নি জেনারেল বিভিন্ন সময়ে আইনজীবীদের নৈতিক বাধ্যবাধকতার কথা তুলে ধরে অসহায় বিচারপ্রার্থীদের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে মামলা পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করে বক্তব্য রেখেছেন।

কিন্তু শুধু নৈতিকতার কথা বলে অপ্রতুল সম্মানীর মাধ্যমে আইনজীবীদের সহায়তা দিতে উৎসাহিত করা কতটা ফলপ্রসু হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাই যেসব আইনজীবী বিনা ফিতে আইনি সহায়তা করবেন, তাঁদেরকে অন্যভাবে প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবার সময় এসেছে।

যেমন কোনো আইনজীবীর ‘সিনিয়র আইনজীবী’ হিসেবে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে বা হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে বা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ বা যেকোনো সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে তাঁদের বিনা মূল্যে আইনি সেবা প্রদানের ‘ট্র্যাক রেকর্ড’ বিবেচনায় আনা উচিত। কিন্তু বিদ্যমান আইনের এই ধরনের পরিবর্তন কোনোভাবেই যথেষ্ট হবে না, যদি না আমাদের নীতিনির্ধারকেরা আইনি সহায়তা প্রদানের ধ্যানধারণা এবং প্রক্রিয়াটির পুরোপুরি সংস্কার না করেন।

জাতীয় আইনি সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত দুই দশকে এই সংস্থার কাঠামোর আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ২০২৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির জাতীয় আইনি সহায়তা প্রদান সংস্থার প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ মানুষ এই সংস্থার আওতায় বিভিন্ন ধরনের আইনি সেবা পেয়েছেন।

কিন্তু এই পরিসংখ্যানের সীমাবদ্ধতা হলো, মোট মামলার সংখ্যার আনুপাতিক হারে আইনি সহায়তাপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা কতটুকু বেড়েছে বা আদৌ বাড়ছে বা কমছে কি–না, তা জানার কোনো উপায় নেই।

২০২৩ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ আইন কমিশনের ১৬৬ নম্বর গবেষণা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আমাদের দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। তাই শুধু বেশিসংখ্যক মানুষ আইনি সহায়তার আওতায় আসছে—এ নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কোনো অবকাশ নেই।

এ ক্ষেত্রে আমাদের নীতিনির্ধারকদের দুটি মৌলিক বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া আশু প্রয়োজন। শুধু কোনো আইনের অধিকার লঙ্ঘিত হলে আদালত বা ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার পেতে বিচারপ্রার্থীকে সহায়তা করতে হবে—এই সংকীর্ণ ধারণাভিত্তিক আইনি সহায়তা দেওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাধারণ নাগরিকদের প্রতিটি বিষয়ে আইনজীবীদের মুখোমুখি হতেই হবে—এই ধারণাও দৃঢ়ভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। এর অর্থ এই নয় যে, আইনজীবীদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে; বরং এ ধরনের ব্যবস্থা মানুষকে আরও অধিকার সচেতন করে তুলবে এবং তাদের আইনের আশ্রয় পাওয়ার সুযোগকে আরও প্রসারিত করবে। আমাদের আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য বরাদ্দ অর্থের আরও অনেক বেশি ফলপ্রসূ ব্যবহার সম্ভব হবে।

সাধারণ নাগরিকের জন্য এমনকি কোনো আইনি অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কি না, এটা বোঝাও অনেক সময় দুরূহ। এ দেশে যখন আমরা একটি স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি, তখন জনগণকে আরও বেশিসংখ্যক স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অনলাইনে আইনি ব্যাপারে তথ্য এবং সেবা পাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বর্তমানে মুসলিম উত্তরাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে অনলাইন ক্যালকুলেটর প্রবর্তন করা হয়েছে, তার বহুল ব্যবহার থেকে ধারণা করা যায়, অনেক সময় তুলনামূলক সহজ বিষয়ে আদালতের কাছে না গিয়েও সাধারণ মানুষ আইন বিষয়ে কিছু ধারণা পেতে সক্ষম।

কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে আদালত কর্তৃক ‘তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার আইন, ২০২০’ পাশ করার মাধ্যমে অনলাইনে বিচারসংক্রান্ত বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু এই আইনে অনলাইন বিচারব্যবস্থাটি অনেকটা অন্তর্বর্তীকালীন বা আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে চালু হয়েছে।

বর্তমানে এই আইনের আওতায় বিচার কাজ চলছে—এমনটা দেখা যায় না। ‘অনলাইন জালিয়াতি সহজ’ এ ধরনের সনাতনী ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। হয়তো একটি জটিল সাক্ষ্য গ্রহণ বা জেরার মতো কার্যক্রম অনলাইনে করা দুরূহ, কিন্তু এ দেশের মামলা নিষ্পত্তির গতি বাড়াতে অনলাইন বিচারকাজ ভূমিকা রাখতে পারে।

তাই শুধু আইনি সেবা প্রদানের বাজেট বাড়ানো এবং বেশিসংখ্যক বিচারক নিয়োগের মাধ্যমে আইনি সহায়তার দ্বার আরও উন্মোচিত হবে বা মামলা নিষ্পত্তির গতি বাড়বে—এ ধরনের সরলরৈখিক ধারণার বৃত্ত থেকে আমাদের বেরোতে হবে।

  • মো. রিজওয়ানুল ইসলাম নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের সদস্য