করোনা মহামারি শুরু থেকে চার বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। এর মধ্যে দেশে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী কমেছে ১০ লাখের ওপরে। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) তাদের ২০২৩ সালের খসড়া প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে। তারা বলছে, ২০১৯ সালে দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৯২ লাখের বেশি। ২০২৪ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮১ লাখ ৬৬ হাজারে। তবে যেসব কলেজে মাধ্যমিক শ্রেণিও পড়ানো হয়, সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজারের মতো বেড়েছে।
কী কারণে এত শিক্ষার্থী কমল, তা নিয়ে ব্যানবেইস গবেষণা করেনি। তবে তারা দেখিয়েছে, এই চার বছরে মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী বেড়েছে আড়াই লাখের মতো। তাহলে বাকি বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কোথায় গেল? ধারণা করা যায়, তারা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে বা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। করোনাকালে অনেক অভিভাবক সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালানোর সামর্থ্য হারিয়েছেন। শিক্ষার্থী কমার পেছনে এ ব্যাপারও ভূমিকা রেখে থাকবে।
১৯৯০ সালে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস হয়েছে। এরপর প্রাথমিকে ধীরে ধীরে প্রায় শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়। তবে এসব শিক্ষার্থীর অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক স্তর পার হতে পারছে না। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষা দেওয়ার আগেই তাদের শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটছে। মাধ্যমিকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ভালো কোনো চাকরি পায় না। তা ছাড়া এসব শিক্ষার্থী অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের অর্জিত শিক্ষা ভুলে যায়। তারা পরিণত হয় অদক্ষ জনবলে।
বাংলাদেশে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য। এ কারণে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির সিংহভাগই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। মূলত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পাস করা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরাই এই শ্রমশক্তির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এসব শিশু-কিশোরকে নিযুক্ত করা হয় বাবার পেশার সহায়তায় কিংবা কোনো শ্রমনির্ভর কাজে।
শিক্ষার্থী যে কারণেই ঝরে পড়ুক না কেন, তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য পরিকল্পনা করা দরকার। উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ ও আওতা বাড়াতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষকেরা যেন শ্রেণিতে পাঠদানে আরও মনোযোগী হন, তা কঠোরভাবে তদারক করতে হবে
এ যুগে আসলে প্রত্যেক অভিভাবকই চান, তাঁর সন্তান লেখাপড়া শিখুক। তবে দরিদ্র অভিভাবককে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিতে হয়। কারণ, ওপরের শ্রেণিগুলোয় শিক্ষার ব্যয় ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। প্রাইভেট-কোচিং, নোট-গাইড, ভর্তি ফি-বেতন, শিক্ষার উপকরণ ইত্যাদি বাবদ প্রচুর খরচ হয়। খরচের এই চাপ সামলাতে পারে না এসব পরিবার। পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পাস-ফেলের ব্যবস্থা আছে, তবে কীভাবে শিখনঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে, সে পরিকল্পনা নেই।
মেয়েশিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার পেছনে আরও কিছু বাড়তি কারণ থাকে। যেমন বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার পথে অনেক ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। আবার এ বয়সেই বাল্যবিবাহ হতে দেখা যায় মেয়েশিক্ষার্থীদের।
অনেক দরিদ্র অভিভাবক মনে করেন, মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলেই সমস্যা মিটে যাবে। মেয়েশিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার হার ছেলেশিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি। ছেলেসন্তানের ক্ষেত্রে মনে করা হয়, সে পড়াশোনা শেষ করে ভবিষ্যতে চাকরি করে সংসারের হাল ধরবে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ছেলেশিশুর পড়াশোনা কষ্ট করে চালানো হলেও মেয়েশিশুর পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করা ও ধরে রাখার জন্য সরকার প্রতিবছর উপবৃত্তিসহ অন্যান্য খাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই ও খাবার দিচ্ছে। এরপরও এত বেশি শিক্ষার্থী কেন ঝরে পড়ছে, এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, অপুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এগুলোও এর পেছনে দায়ী।
শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরে ব্যয় করার জন্য বিশ্বব্যাংক গত বছরের শেষে ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন দেয়। কোভিডজনিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে, শিখনফলের মানোন্নয়ন ঘটাতে এবং শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনতে এ অর্থ ব্যয় করার সুপারিশ করেছে তারা। এ বছর মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে ইউনিসেফ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এসব পদক্ষেপ ও উদ্যোগ সমন্বিত করে কাজ করতে হবে।
প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিদ্যালয় ও অভিভাবকের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। ক্লাসে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করতে হবে এবং তার ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না, তাদের প্রয়োজনে কারিগরি শাখায় যুক্ত করা যেতে পারে। শিক্ষা উপকরণের দাম কমাতে হবে। শিক্ষা বিস্তারে দারিদ্র্যবান্ধব যেসব কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলো সফল করে তুলতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শিক্ষা যাতে আনন্দদায়ক হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
তবে মূল কাজটি কী হবে, তা ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রস্তাব আকারে লেখা আছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রস্তাব এমন—বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত অবস্থা ও শিক্ষার পরিবেশের মান বাড়ানো, শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের জন্য হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে বিদ্যালয়ের সময়ে পরিবর্তন আনা, মেয়েশিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ের যাতায়াতের পথ নিরাপদ করা, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণ করা ইত্যাদি।
শিক্ষার্থী যে কারণেই ঝরে পড়ুক না কেন, তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য পরিকল্পনা করা দরকার। উপবৃত্তির টাকার পরিমাণ ও আওতা বাড়াতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে শিক্ষাকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষকেরা যেন শ্রেণিতে পাঠদানে আরও মনোযোগী হন, তা কঠোরভাবে তদারক করতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করেছে, তাদের দ্রুত ফিরিয়ে আনার জন্য সামাজিক-আর্থিক সহায়তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক