আর্থিক খাতে লুটপাটের দায় জনগণ শোধ করবে কেন?

রাতের আঁধারেই ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম।
ছবি : প্রথম আলো

নজিরবিহীনভাবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। জনসাধারণ নতুন করে আর্থিক চাপের মুখে পড়বে। প্রাত্যহিক জীবনের খরচ বাড়বে সর্বত্র। এই চাপ সামাল দেওয়ার সংগতি সাধারণ মানুষের নেই। কেবল জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতেই এর শেষ হবে না। এর পিছু পিছু বিদ্যুতের দাম বাড়বে। পরিবহন খরচ বাড়বে। বাসাভাড়া ও বাজারের ফর্দে অতিরিক্ত অর্থ খরচ হিসাবে নতুন করে যুক্ত হবে। নাগরিকের গলায় ব্যয়ের ফাঁস আরও শক্ত করে এঁটে বসবে। এখনই দম ফেলার আর সুযোগ থাকছে না।

অথচ এমন একসময় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো, যখন বিশ্ববাজারে দাম কমেছে খুচরা ও পাইকারি উভয় পর্যায়েই। রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা করলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১৩৯ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল ব্যারেলপ্রতি। এখন ৯০ ডলারে নেমে এসেছে। বিভিন্ন জ্বালানি তেলবিষয়ক সংস্থার পূর্বাভাস হচ্ছে এ বছরের শেষ নাগাদ ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারে নেমে আসবে। বিশ্ববাজারে যখন ধীরে ধীরে স্বস্তি ফিরে আসছে, তখনই আমাদের বাজারে দাম বাড়িয়ে চরম অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল সরকার।

মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে সরকার ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছে। প্রথমত, বিশ্ববাজারে সংকট ও মূল্যবৃদ্ধিকে মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কামানো ও ভারতে পাচাররোধকেও মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো আইএমএফের শর্তকে দায়ী করেছে। সম্প্রতি সরকার আইএমএফের কাছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। ঋণ প্রদানের শর্ত হিসেবে আইএমএফ ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে বলে এই দলগুলো অভিযোগ করেছে এবং এই পরামর্শ মোতাবেক সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি হ্রাসের উদ্যোগ নিয়েছে।

এই হচ্ছে মোটাদাগে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর যুক্তি।

উল্লেখ্য, আমাদের দেশে কখনোই আইন মেনে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয় না। আইন অনুসারে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গণশুনানি করে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেবে। গণশুনানির ৯০ দিনের মধ্যে সরকার তেলের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করবে। কিন্তু এই নিয়ম কোনো সরকারের আমলেই মানা হয়নি। প্রতিবারই সরকার ও আমলারা মিলে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করেছে এবং রাতের বেলায় সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়। এবারও সরকার এই ধারা থেকে বের হতে পারেনি। রাতের আঁধারেই ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম।

দেশ শ্রীলঙ্কা হবে না, পাকিস্তানের পথে যাবে না বা লাইবেরিয়ার পরিণতি ভোগ করবে না—এসব অবান্তর আলোচনা। এসব বিষয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট না করে জনজীবনের ওপর দিয়ে যে ধকল যাচ্ছে বা যাবে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, আমদানির নামে অর্থ পাচার, বিনা উৎপাদনে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অর্থ লোপাটের দায় জ্বালানি তেল, পরিবহন সেবা, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষ শোধ করবে কেন?

সরকারের মূল্যবৃদ্ধির কোনো যুক্তিই গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ববাজারে সর্বোচ্চ দাম থাকার সময় সরকার ভর্তুকি দিয়েছে। এখন দাম কমার সময় অযৌক্তিকভাবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ হারে দাম বাড়িয়েছে। কারণ হিসেবে বিপিসির লোকসানের কথা বলা হচ্ছে। জুলাই মাসে বিপিসি ডিজেল ও অকটেনে ৭৮ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি থেকে লোকসানের পরিমাণ ৮ হাজার ১৪ কোটি টাকা। অথচ ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভ করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

ফলে দেখা যাচ্ছে, বিপিসির লোকসানের যে কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তা সর্বাংশে সঠিক না। তর্কের খাতিরে সরকারের যুক্তি মেনে নিয়েই বলতে হবে বিপিসি এখনো লাভেই আছে। ফেব্রুয়ারি থেকে লোকসানের অর্থ বাদ দিলেও বিপিসির হাতে এখনো ৩৫ হাজার কোটি টাকা থাকার কথা। এই অর্থ থেকে সরকার জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে পারত। না দিয়ে সরকার অন্য খাতে এই ব্যয় করছে। এ ছাড়া সরকার জ্বালানি তেল আমদানিতে ৩৭ শতাংশ শুল্ক–কর আদায় করে। এখানে সরকার শুষ্ক–কর কমাতে পারত।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব জনজীবনে ভয়ংকর রকম নেতিবাচক হবে। সরাসরি কৃষিতে কু প্রভাব পড়বে। দেশে ডিজেলের চাহিদা আছে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টন। এর ১৫ শতাংশ কৃষিতে ব্যবহার হয়। এর আগে সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন তেলের দাম বাড়ায় কৃষি উৎপাদন ব্যয় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ফলে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে ভোক্তা পর্যায়ে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবহন ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে, কারণ আমাদের পরিবহন খাত পুরোটাই ডিজেলনির্ভর।

রাজনৈতিক দলগুলো আইএমএফসহ বিভিন্ন গৎবাঁধা কারণ উল্লেখ করলেও আসল কারণটি বোধ হয় কেউ বলছে না। সরকার বলছে না নিজেদের নিরাপত্তার কারণেই। কিন্তু বিএনপিসহ অন্যান্য দলগুলো এ বিষয়টি কেন আলোচনায় রাখতে পারছে, তা বোধগম্য না।

এর মূল কারণ হচ্ছে আর্থিক খাতে একধরনের লুটপাট ও অর্থ পাচারের কারণে সম্ভবত সরকারের হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই। বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলের পরিমাণ নিয়ে নানা ধরনের আলাপ–আলোচনা শোনা যাচ্ছে। ফলে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ বিভিন্নভাবে জনসাধারণের পকেট কাটার চেষ্টা করছে। বৈশ্বিক সংকট বা বিপিসির লোকসানের কারণ উল্লেখ অজুহাত মাত্র। গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে, জ্বালানি তেল বা খাদ্য আমদানির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে চাপ পড়েনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে জ্বালানি পণ্যের আমদানি ব্যয় কমেছে ১১ শতাংশ। আর খাদ্যে ৪ শতাংশ কমেছে। অথচ এই অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এর পরিমাণ ছিল ৮৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র এবং মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতেই ব্যয় হয়েছে ৬৩ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার, যা মোট আমদানি খরচের ৭১ শতাংশের বেশি। এটা ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট আমদানি ব্যয়ের প্রায় কাছাকাছি। ওই অর্থবছরে ৬৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। মূলত অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি বাণিজ্যের ভারসাম্যকে ধসিয়ে দিয়েছে।

এই অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হতে পারে দেশ থেকে অর্থ পাচার। যে পরিমাণ আমদানির কথা বলা হচ্ছে, শিল্পায়ন–কর্মসংস্থানসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতির সূচকে এর প্রতিফলন নেই। যেসব পণ্য আমদানির কথা বলে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল, সেই সব পণ্য আদৌ দেশে এসেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে অপখরচ করা হয়েছে। এক বিদ্যুৎ খাতেই ৯০ হাজার কোটি টাকা বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সরকার দিয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে। এ খাত থেকেও অর্থ বিদেশে পাচার হতে পারে।

দেশের অর্থনীতিতে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যে যেভাবে পারছে বাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। শেয়ারবাজার থেকে ব্যাংকের হিসাবে কোথাও আমানতকারীর অর্থ নিরাপদ না। বেসরকারি অনেক ব্যাংক পথে বসে যাচ্ছে অর্থনৈতিক অনিয়মের কারণে। আর্থিক কেলেঙ্কারি, অস্বাভাবিক আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, অর্থ পাচার ও বিশাল অপখরচের ধাক্কা সামলানোর মতো শক্তি আমাদের অর্থনীতির নেই। দেশ শ্রীলঙ্কা হবে না, পাকিস্তানের পথে যাবে না বা লাইবেরিয়ার পরিণতি ভোগ করবে না—এসব অবান্তর আলোচনা। এসব বিষয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট না করে জনজীবনের ওপর দিয়ে যে ধকল যাচ্ছে বা যাবে, তা বিবেচনায় নিতে হবে। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার, আমদানির নামে অর্থ পাচার, বিনা উৎপাদনে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর অর্থ লোপাটের দায় জ্বালানি তেল, পরিবহন সেবা, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষ শোধ করবে কেন?

ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক