ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

মতামত

ইসরায়েলের লাভের চেয়ে তুলনাহীন ক্ষতিই হলো

৭ এপ্রিল ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধের, যা এ অভিযানের কোনো মাইলফলক হলো না। বরং এখন এটাই মনে হচ্ছে, ইসরায়েলের কারোরই কোনো ধারণা নেই যে কীভাবে ইতিহাসের এই জঘন্যতম যুদ্ধ শেষ করতে হবে।

এই যুদ্ধের খরচ ক্রমেই স্তূপাকারে বাড়ছে, যা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। আর প্রাপ্তি বা লাভ তো নগণ্য, বলতে গেলে নেইই। সে কারণেই এখন আমাদের সমবেতভাবে সাহস সঞ্চয় করে বলতে হবে, ছয় মাস ধরে চলা বিপর্যয় থেকে মনে হচ্ছে, যুদ্ধটা না হলেই ভালো হতো।

ইসরায়েলের হাতে বিকল্প ছিল যুদ্ধে না যাওয়ার। এ পর্যন্ত যা হয়েছে, তা–ই যদি ফলাফল হয়, তাহলে বরং সংবরণ নীতি নিয়ে যাঁরা ৭ অক্টোবরের ভয়াবহতার জন্য দায়ী, শুধু তাঁদেরই শাস্তি দিয়ে অগ্রসর হওয়া যেত। এতে সবাই লাভবান হতো, শুধু ইসরায়েলের পৌরুষত্ব ও সামরিক অহংবোধ ছাড়া যা বরাবরই অসমানুপাতিক প্রতিদান ও শাস্তি আরোপ করেছে এবং তা যে মূল্যেই হোক না কেন। এটাতো চূড়ান্তভাবে শিশুসুলভ ও বোকামির নীতি। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো, ইরানের বিরুদ্ধেও ইসরায়েল এই নীতি অনুসরণ করতে যাবে।

সর্বাধুনিক ভূমিভেদী রাডার দিয়েও গাজার ধ্বংসস্তূপ ও কবরগুলোর ভেতরে গর্ত করে এই যুদ্ধে ইসরায়েলের জন্য লাভজনক একটি উপাদানও খুঁজে বের করা যাবে না। বিপরীতে তুলনাহীন ক্ষয়ক্ষতি তো খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে।

অবশ্য আগেও এগুলো বলা হয়েছে, যদিও কোনো কাজ হয়নি। কিন্তু সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা হলো দুনিয়াজুড়ে ইসরায়েলর নৈতিকতার ধস, যা প্রায় অফেরতযোগ্য। ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়ার আরও কয়েক বছর লেগে যাবে আগের অবস্থানে ফিরে আসতে। ইসরায়েলকেও একইভাবে আরও অনেক বছর কাজ করতে হবে গাজা যুদ্ধের পর আগের অবস্থানে ফেরে যেতে। কিন্তু রাশিয়ার চেয়ে ইসরায়েলের অবস্থা অনেক নাজুক।

বহির্বিশ্বে ইহুদিবিদ্বেষের (অ্যান্টিসেমিটিজম) ঘটনাগুলো আলাদা করে সরিয়ে রাখুন, সেগুলোর সামান্য কিছু সত্যি। গাজায় ইসরায়েল যা করছে, তা দেখার পর যে কারোরই ঘৃণা ও বিদ্বেষ জন্মাবে। দুনিয়া কী ভাবল, সেটাও বাদ দিয়ে আমাদের অবস্থাটা একবার দেখি। আমরা তো সব সময়ই ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগের বিষয়ে ঔদাসীন্য দেখিয়ে এসেছি। আর এবার আমরা এই চরম উদাসীনতার নতুন এক দানবীয় বিবরণী তৈরি করেছি।

যুদ্ধের আগামী ছয় মাস এই প্রথম ছয় মাসের চেয়ে আরও খারাপ হতে পারে। রাফায় অভিযান চালানো হলে এত দিন আমরা যে গণহত্যা চালিয়েছি, তার একটা ছোট বিজ্ঞাপনচিত্র (মুভি ট্রেলার) দেখা যাবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য ইসরায়েলের উত্তর সীমান্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, ইরানও সংক্ষুব্ধ হবে। ভালো হয় পুরোপুরি বাস্তবসম্মত ভয়াবহ কিছু দৃশ্যকল্প তৈরি না করলে।

সেদে তেইমান বন্দিশিবিরে নিয়মিতভাবে মানবদেহ থেকে বিভিন্ন অঙ্গ অপসারণ করা হয়ে আসছে, যার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। গাজায় ১৭ হাজার শিশু এতিম বা মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তারও কিছু হয়নি। ইসরায়েলি চিকিৎসকেরা সেদে তেইমানের বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি। ইসরায়েলি সমাজসেবীরা গাজার ক্ষুধার্ত এবং নিহত বা হত্যা করা হয়েছে, এমন শিশুদের বিষয়েও কোনো কথা বলেননি। আমরা তো দানবে রূপান্তরিত হয়েছি, শুধু আমাদের কর্মকাণ্ড দিয়েই নয়, বরং সবকিছুর ওপর আমাদের নির্লিপ্ততা দিয়েও।

একসময় কিছু ইসরায়েলি ছিলেন, যাঁরা মর্মাহত হতেন এবং পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য চিৎকার করতেন। তাঁরা প্রায় সবাই চলে গেছেন। সেদে তেইমানের মাত্র একজন ন্যায়পরায়ণ চিকিৎসক একটা চিঠি লিখেছিলেন। তবে এখনো তিনি ওখানকার শয়তানদের সঙ্গে সহযোগিতা বজায় রেখেছেন কি না, জানা যায়নি।

ছয় মাসের কিছু বেশি আগে অক্টোবরের সাত তারিখ রোববার ইসরায়েলের বিবেকবোধ ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন সব ইসরায়েলীর মধ্যে একটাই চিন্তা: আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। শুধু আমাদের দুর্যোগ, আমাদের ভোগান্তি, আমাদের আত্মত্যাগ এবং আর সবকিছুই এ জন্য পুড়িয়ে ফেলা যায়।

অথচ যখন গাজার সবচেয়ে বড় ও আধুনিক চিকিৎসাকেন্দ্র আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন ইসরায়েলের আত্মাও পুড়ে যায়, যা আগের চেয়ে বেশি সমস্যাগ্রস্ত। এই যুদ্ধ শেষে গাজা ধ্বংস হবে, গাজাবাসী সব নিহত হবে আর আয়নায় আমাদের ভিন্ন চেহারা দেখতে পাব। দুনিয়া আমাদের ভিন্নভাবে দেখবে, কোনো শয়তান রাষ্ট্রকে দুনিয়া যেভাবে দেখুক বলে আমরা সবাই আশা করি, সেভাবে।

অবশ্য আগের চেয়ে অনেক বেশি ইসরায়েলি এখন বুঝতে শুরু করেছেন আর সাহস নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। তাঁরা ৭ অক্টোবর–পরবর্তী প্রমত্ত অবস্থা থেকে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই তো শর্তহীন যুদ্ধবিরতির ডাক জোরালো হচ্ছে, এমনকি হারেৎজের পাতা থেকেও। কিন্তু তা হচ্ছে বড় দেরিতে আর দ্বিধাগ্রস্তভাবে। গত ছয় মাসে রক্তপিপাসা ও ধর্ষকাম ঘনিষ্ঠভাবে বেড়ে উঠেছে এবং ইসরায়েলে রাজনৈতিকভাবে সঠিক বিবেচিত হচ্ছে।

তবে যুদ্ধের আগামী ছয় মাস এই প্রথম ছয় মাসের চেয়ে আরও খারাপ হতে পারে। রাফায় অভিযান চালানো হলে এত দিন আমরা যে গণহত্যা চালিয়েছি, তার একটা ছোট বিজ্ঞাপনচিত্র (মুভি ট্রেলার) দেখা যাবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য ইসরায়েলের উত্তর সীমান্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, ইরানও সংক্ষুব্ধ হবে। ভালো হয় পুরোপুরি বাস্তবসম্মত ভয়াবহ কিছু দৃশ্যকল্প তৈরি না করলে।

ইসরায়েলকে তো তার জিম্মিদের [হামাসের হাতে আটক হওয়া] মরদেহ সংগ্রহ করা অব্যাহত রাখতে হবে। পশ্চিম তীরও এই যুদ্ধের একটি পক্ষ হয়ে উঠবে। এভাবে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইসরায়েল এত সবকিছুর মুখে পড়বে এবং একা।

সুতরাং এসবের চেয়ে ভালো হয়, এখানেই থেমে যাওয়া। বাস্তবমুখী ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির বিবরণী তৈরি বাদ দিয়ে থেমে যাওয়া এবং যুদ্ধ বন্ধ করা। প্রথম ছয় মাস আমাদের জন্য অনেক বেশি হয়ে গেছে। আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে গভীরভাবে নিমজ্জিত হয়ে গেছি, যা মোকাবিলা করা আমাদের জন্য দুরূহ হয়ে পড়েছে।

  • গিডিয়ন লেভি একজন ইসরায়েলি সাংবাদিক। নিবন্ধটি ইসরায়েলি পত্রিকায় হারেৎজে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আসজাদুল কিবরিয়া