আমরা স্কুলজীবনে অনেক কষ্ট করে বাগ্ধারা শিখতাম। বর্তমানে এমন একটি বাগ্ধারার বেশ ব্যবহার হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। সেটি হচ্ছে ‘ফুটন্ত কড়াই’ থেকে ‘জ্বলন্ত উনুনে’ পড়ে যাওয়া!
প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টি আরও ভয়ংকর। এই বাগ্ধারা বলতে তাই বোঝায়, ছোট বিপদ থেকে বাঁচতে গিয়ে বড় বিপদের খপ্পরে পড়া।
কয়েক বছর ধরে বাগ্ধারাটি প্রায়ই ব্যবহার করছে কিছু বাম রাজনৈতিক দল। তারা কড়াই বলতে আওয়ামী লীগকে, উনুন বলতে বিএনপিকে বোঝায়।
কাজেই তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন করে তাদের ক্ষমতায় বসালে সমস্যা আরও বাড়বে। এটি না করার চিন্তা থেকে তারা প্রয়োজনে জনগণের ভোটাধিকার আন্দোলনকে দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন রাখতে রাজি আছে, এমনকি রাজি আছে বর্তমান একচ্ছত্র শাসনব্যবস্থা এবং এর নানা অন্যায় ও অনিয়ম সব মেনে নিতেও।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সম্পর্কে একই ধরনের মনোভাব পোষণ করেন আমাদের নাগরিক সমাজের অনেকে। এমন মনোভাব যে কতটা জোরালোভাবে তাঁদের কাজকে প্রভাবিত করছে, এর আভাস পেলাম দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ইফতেখারুজ্জামানের কয়েক দিন আগের বক্তব্যে।
‘ঢাকা ফোরাম’ আয়োজিত সেদিনের আলোচনা অনুষ্ঠানে নানা বিষয়ের মধ্যে নাগরিক সমাজের বর্তমান ভূমিকার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়।
সেখানে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নাগরিক সমাজ এখন প্রত্যাশিতভাবে কাজ করতে পারছে না দুটি কারণে। এক. সরকারের নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণনীতি ও খবরদারি। দুই. নাগরিক সমাজের কেউ কেউ ফুটন্ত কড়াই আর জ্বলন্ত উনুনতত্ত্বে বিশ্বাস করেন; তাঁদের মধ্যে এই দ্বিধা কাজ করে যে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে কোনটি আসলে কম খারাপ।
ইফতেখারুজ্জামানের কথার মানে হচ্ছে, নাগরিক সমাজের কেউ আওয়ামী লীগকে, কেউ বিএনপিকে কম খারাপ ভাবেন, অন্য দলকে বেশি খারাপ ভাবেন। আমি মনে করি, এটি ভাবা তাঁদের ব্যক্তিগত পছন্দ ও স্বাধীনতার বিষয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই ভাবনা থেকে তাঁরা নাগরিক আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন, আমলবিশেষে নিজেরা সোচ্চার বা নিশ্চুপ থাকেন।
আমি মনে করি, নানা বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুটি দলকে খারাপ ভাবার কারণ রয়েছে। কিছু ভালো কাজের পাশাপাশি ক্ষমতায় থাকাকালে দুটি দলই কমবেশি দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্বাচনে কারচুপিসহ নানা অনাচার করে থাকে। তাই নাগরিক সমাজের কারও কাছে বিএনপিকে বেশি খারাপ, কারও কাছে আওয়ামী লীগকে বেশি খারাপ মনে হতে পারে।
তবে আমি মনে করি, উপরিউক্ত সাবজেক্টিভ বিবেচনা থেকে কখনো নাগরিক সমাজের ইস্যুভিত্তিক বা অবজেকটিভ আন্দোলনকে দুর্বল করা উচিত নয়। সেখানে মুখ্য থাকা উচিত ন্যায়-অন্যায় বোধ, কে এই বোধের সুবিধা পাবে—এ বিবেচনা নয়। যেমন আমরা যদি মানুষের ভোটাধিকারে বিশ্বাস করি, তাহলে যে আমলেই ভুয়া নির্বাচন হবে, তার বিরুদ্ধে সবার দাঁড়ানো উচিত।
সঠিক ভোট হলে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ, কে ক্ষমতায় আসবে, এটি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নাগরিক সমাজের কাছে বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না; তার কাছে বিবেচ্য বিষয় হবে মানুষের ভোটাধিকার রক্ষিত হচ্ছে কি না, সেটি।
আমি একমত যে দ্বিতীয় দলটি ক্ষমতায় এসে নিজেরাও অনাচার করতে পারে, কিন্তু এর মাত্রা নির্বাচন বাদেই ক্ষমতায় থাকতে পারায় আত্মবিশ্বাসী দলের অনাচারের চেয়ে বেশি হতে পারে না। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বারবার পরিবর্তিত সরকারগুলোর সঙ্গে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নামমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা দলটির পারফরম্যান্স নির্মোহভাবে তুলনা করলে আমরা সহজেই তা বুঝতে পারব।
তাঁদের কেউ কেউ যদি মনে করেন, ভোটাধিকার রক্ষিত হলে তাঁদের অপছন্দের ‘বেশি খারাপ’ দলটি ক্ষমতায় আসতে পারে, তবু তাঁদের জনগণের ভোটাধিকার ও তাদের সার্বিক বিবেচনাবোধের ওপর শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। কারণ, বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সব বৈশ্বিক ও জাতীয় মানবাধিকার দলিলে গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তিই হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার।
একইভাবে আমরা যদি ১৯৭২ সালের সংবিধান বিশ্বাস করি, নিজেদের মানবাধিকারকর্মী ভাবি, তাহলে সব ধরনের নিপীড়ন, নির্যাতন ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। এখানে বিবেচ্য হতে হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নটি, ভিকটিম বা অপরাধী কাকে আমি কতটা পছন্দ বা অপছন্দ করি, প্রতিবাদ করা বা না করার ক্ষেত্রে তা বিবেচ্য বিষয় হতে পারে না। আবার দেশে দুর্নীতি হলে শাসক দলের সমালোচনা নির্মোহভাবে করতে হবে, শাসক দলের কোন পরিবার আমার প্রিয় বা কোনটি বেশি অপছন্দের, এটি সমালোচনা করার নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারে না।
আমরা অনেকে এটি মনে রাখি না।
আমি এ-ও বিশ্বাস করি যে ফুটন্ত কড়াই আর জ্বলন্ত উনুনতত্ত্ব দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভুল একটি প্রপঞ্চ। দেশে যখন সুষ্ঠু নির্বাচন হতো, তখন হয়তো এটি বলার অবকাশ ছিল। কিন্তু পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের বিষাক্ত তেজে বলীয়ান হয়ে ফুটন্ত কড়াই এখন এতটাই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে এর সঙ্গে ক্ষমতার আগুনের বাইরে থাকা নিবু নিবু উনুনের আর তুলনা হয় না।
আমাদের বরং এটিও বোঝা বাঞ্ছনীয় যে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতাবদলের সমূহ সম্ভাবনা থাকে বলে কড়াই আর উনুন—কোনোটিই বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা থাকলে ক্ষমতায় থাকা দলের এই আশঙ্কা থাকে যে পাঁচ বছর পর তাদের ক্ষমতা হারাতে হতে পারে। তখন অন্য দল ক্ষমতায় এসে তাদের সব অপকর্মের বিচার করতে পারে, প্রচারমাধ্যমে সবকিছু তুলে ধরতে পারে, প্রতিটি ইটের জবাব পাটকেল দিয়ে দিতে পারে।
এসব আশঙ্কা বজায় থাকলে ক্ষমতায় থাকা দল পরের নির্বাচনে পরাজয় এড়ানোর চিন্তা করে এবং এই চিন্তা থেকে কিছুটা হলেও অপকর্ম কম করার চেষ্টা করে। কিন্তু ভুয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকায় বারবার সফল হতে পারলে কোনো শাসক দলের এসব আশঙ্কা আর থাকে না। অনাচার, দুর্নীতি ও অপকর্ম করার আত্মবিশ্বাস তখন তুঙ্গে ওঠে। অন্যদিকে বহু বছর ধরে নির্যাতিত ও নিপীড়িত থাকার কারণে অন্য দলটির তখন প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষমতা খর্বতর হতে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে কর্তৃত্ববাদী শাসক দলকে কম খারাপ ভাবা, অন্যদিকে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীন হয়ে উপরিউক্ত দলটিকে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে—এমন বিরোধী দলকে বড় শয়তান ভাবা কতটুকু যৌক্তিক, তা আমরা ভেবে দেখতে পারি।
আমি একমত যে দ্বিতীয় দলটি ক্ষমতায় এসে নিজেরাও অনাচার করতে পারে, কিন্তু এর মাত্রা নির্বাচন বাদেই ক্ষমতায় থাকতে পারায় আত্মবিশ্বাসী দলের অনাচারের চেয়ে বেশি হতে পারে না। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বারবার পরিবর্তিত সরকারগুলোর সঙ্গে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নামমাত্র নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা দলটির পারফরম্যান্স নির্মোহভাবে তুলনা করলে আমরা সহজেই তা বুঝতে পারব।
আমাদের প্রধান ফোকাস তাই হওয়া উচিত সুষ্ঠু নির্বাচন তথা মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা, মানুষের সম্মতিহীন ক্ষমতার বিরুদ্ধে সবার অবস্থান নেওয়া।
নাগরিক সমাজ থেকে আমরা প্রায়ই রাজনৈতিক দলগুলোকে আত্মসমালোচনা করতে বলি। আমার মনে হয়, একই কাজ আমাদের নাগরিক সমাজেরও করা উচিত। অহমিকা, ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তা, সংকীর্ণ বিবেচনাবোধ আমাদেরও রয়েছে। এসব দুর্বলতা দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় আমাদের শক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যেমন কড়াই আর উনুনতত্ত্বে বিভক্ত থেকে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার শক্তি বৃদ্ধিতে পরোক্ষভাবে হলেও আমরা অবদান রাখছি, নিজেরাও অনেকে সেই শাসনব্যবস্থার নিপীড়নের শিকার হচ্ছি।
এসব অপ্রিয় সত্য আমরা কি ভেবে দেখতে রাজি আছি?
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক