আমাদের দেশের শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্র, সরকার, সরকারি দল—তিনটি ভিন্ন সত্তা। প্রত্যেকের আলাদা বৈশিষ্ট্য, আলাদা কর্মপরিধি, আলাদা দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। তবে এগুলো পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে শুধু একটি অভিন্ন ও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য, যা হলো দেশ ও জাতির কল্যাণে। এটাই হওয়ার কথা স্বাভাবিকভাবে।
রাষ্ট্র অর্থ সম্পূর্ণ দেশ (ভূখণ্ড), তার অন্তর্গত দলমতধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে, জনগণ, দেশের সব সম্পদ ও ক্ষমতা। রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারকে সহায়তা করবেন। কাজ করবেন সরকারের হয়ে। তবে তাঁরা রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করবেন। রাষ্ট্রের স্বার্থ সংরক্ষণে তৎপর থাকবেন। কোনো বিশেষ ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল বা বিশেষ করে সরকারি দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন না বা তাদের হয়ে কোনো কাজ করবেন না। রাষ্ট্রের চোখে সব নাগরিক ও নাগরিকদের সংগঠন সমান।ক
সে জন্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মচারীদের ও সব নাগরিক বা নাগরিকদের সংগঠন ইত্যাদিকে একই দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে হবে। এ বিষয়ে বৈষম্য সৃষ্টি রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য দেশ ও জাতির মঙ্গলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
রাজনৈতিক দল অর্থ রাজনীতি করার উদ্দেশ্যে গঠিত নাগরিকদের সংগঠন। কোনো রাজনৈতিক দল যখন সাংবিধানিকভাবে বা আইনসংগতভাবে সরকার গঠনে দায়িত্ব লাভ করে ও সরকার গঠন করে, তখন সে দল হয় সরকারি দল। সরকারি দল সরকারের জনহিতকর পরিকল্পনা ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করে সরকারের পক্ষে জনসমর্থন বৃদ্ধি ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার প্রয়াস অব্যাহত রাখবে; যাতে তাদের দল গণমানুষের আস্থা অর্জন করে পুনরায় রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে পারে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্র, সরকার ও সরকারি দল—এই তিন সত্তার নিজস্বতা বিলীন হতে দেখছি। সেগুলোকে এক ও অভিন্ন সত্তায় রূপ নিতে দেখা যাচ্ছে। যেমন রাষ্ট্র ও সরকার দুটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে মিশে যাচ্ছে, কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। একইভাবে সরকারি দল ও সরকারের মধ্যেও পার্থক্য থাকছে না।
রাষ্ট্রের কর্মচারীরা সরকারি দলের হয়ে কাজ করছেন। আবার সরকার রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে ও বণ্টন করে সরকারি দল ও সমর্থকদের সমৃদ্ধ করছে। দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব বিষয়ে রাষ্ট্র ও সরকার উভয়েই সরকারি দলের হয়ে কাজ করছে। তারা এমনভাবে কাজ করছে, যেন রাষ্ট্র ও সরকার সার্বিকভাবে সরকারি দলেরই অংশ।
কথা বলার অধিকার ও মতপ্রকাশের অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় ইত্যাদি কারণে কিছু বিধিনিষেধ থাকতেই পারে। তবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রজাগণ তাঁদের প্রতিনিধি বা প্রতিনিধিত্বকারী সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মতামত প্রকাশে বাধাগ্রস্ত হবেন, এটা মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা অথবা আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী। সত্যিকার অর্থে, সরকারের সমালোচনা শুধু অধিকার নয়, এটা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য কর্তব্য বলা যায়।
সরকারি দল দলীয় কর্মকাণ্ডে সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করছে। যদি সরকার মনে করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার বৈধ, তাহলে সব রাজনৈতিক দলকে এই সুবিধা দেওয়া উচিত। কিন্তু অন্যান্য রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না। শুধু তা–ই নয়, যেসব রাজনৈতিক দল বা সংগঠন সরকারের প্রতিপক্ষ বলে বিবেচিত হয়, তাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেকে এ রকম অভিযোগও করছেন, সরকারবিরোধী কর্মসূচিকে রাষ্ট্রবিরোধী কাজ বলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এসব কারণ আমাদের শাসনপদ্ধতির স্বাভাবিকতা বিনষ্ট করছে। দেশে সুস্থ রাজনীতির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। দেশের মানুষ বিভিন্নÿ ক্ষেত্রে তাঁদের ন্যায্য অধিকার হারাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে এতে মানুষের মধ্যে একধরনের হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশ ক্রমান্বয়ে অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাযুদ্ধের ফসল। এ দেশ প্রজাতন্ত্র; অর্থাৎ প্রজারাই এ দেশের মালিক এবং সে কারণে দেশের সকল ÿক্ষমতার মালিক। এটা রাজতন্ত্র নয়, যেখানে প্রজাদের দেশের ওপর কোনো অধিকার থাকবে না। প্রজারা বা সাধারণ নাগরিকেরা সরকার পরিচালনার কাজে বা রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবে, এটাই প্রজাতন্ত্র গঠনের মূল উদ্দেশ্য। সে কারণে এটিকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল চেতনা বলা যায়।
সাধারণ নাগরিক বা প্রজারা তাঁদের হয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। উদ্দেশ্য, প্রতিনিধিরা প্রজাদের পছন্দমাফিক দেশ পরিচালনা করবেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাঁদের ইচ্ছা–অনিচ্ছার প্রতিফলন না দেখলে তাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি বা সরকার পরিবর্তন করবেন। এ প্রক্রিয়ায় জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করা ও সে পরিপ্রেক্ষিতে ‘আইনের শাসন সমৃদ্ধ ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজব্যবস্থা’ গড়ে তোলা হবে। এই প্রত্যাশা নিয়েই ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের’ অভ্যুদয় হয়েছে।
কথা বলার অধিকার ও মতপ্রকাশের অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় ইত্যাদি কারণে কিছু বিধিনিষেধ থাকতেই পারে। তবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রজাগণ তাঁদের প্রতিনিধি বা প্রতিনিধিত্বকারী সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মতামত প্রকাশে বাধাগ্রস্ত হবেন, এটা মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা অথবা আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী। সত্যিকার অর্থে, সরকারের সমালোচনা শুধু অধিকার নয়, এটা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য কর্তব্য বলা যায়। কেউ কিছু না বললে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার কীভাবে নিজেদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ‘দেশের মালিক প্রজাদের’ মূল্যায়ন জানতে পারবে এবং সে অনুযায়ী জনকল্যাণে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে।
যারা যেকোনো প্রক্রিয়ায় সমালোচনার দ্বার রুদ্ধ করে, তারা প্রজাতন্ত্র বা প্রজারাই দেশের মালিক, তা বিশ্বাস করে না। সে অর্থে তারা স্বাধীনতার মূল চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করছে, বলা যায়।
উপরিউক্ত বিষয় গণতন্ত্র চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং এগুলো স্বৈরতন্ত্র বিকাশে পরিবেশ সৃষ্টি করে। সে কারণে মতপ্রকাশে, বিশেষ করে সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে সমালোচনা করায় বাধা সৃষ্টিকারী আইন ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের অবসান অত্যন্ত জরুরি।
গোলাম মোহাম্মদ কাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান