মতামত

তুমি মারবার অধিকার পাইলা কই

নিখোঁজ বাবা পারভেজ হোসেনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়ে আদিবা ইসলাম। গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে তাঁদের স্বজনেরা ‘মায়ের ডাক’-এর ব্যানারে মানববন্ধন করেন। সম্প্রতি প্রেসক্লাবের সামনে।
ছবি: প্রথম আলো

কারওয়ান বাজারে একবার দুই উঠতি কিশোরের হাসিঠাট্টার পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে তাদের কথা শোনা গেল। ভাসমান দুই কিশোর—বাসি সবজি টুকিয়ে, ট্রাক থেকে মাছ নামানোর সময় একটুখানি ‘হাত লাগিয়ে’ হয়তো তাদের দিন যায়—লাঠিকে বন্দুক বানিয়ে তাক করে ধরে ছিল একজন আরেকজনের দিকে। কপট রাগ দেখিয়ে বলছিল, ‘আর করবি, ক আর করবি? তাইলে অ্যাক্কেরে করোসফায়ার কইরা দিমু কইলাম।’
হাসিঠাট্টার ঢঙে ভীতিকর হুমকিই বটে! ক্রসফায়ারের দুর্বল গল্পগুলো তবে ওই ভাসমান কিশোরেরাও জানে—ভাবনাটা এলেও চমকে ওঠা যায়নি।

ক্রসফায়ার, গুম আর থানাহেফাজতে মৃত্যু এখন দৈনন্দিন খবর হয়ে আসে। বিভিন্ন কায়দায় ও মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টাও চলছে। অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সংস্থা বিচারবিহীন হত্যাকাণ্ড, গুম, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যুপদ্ধতির বহুল ব্যবহারের মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণকে যতটা ভীতির মধ্যে রাখতে চেয়েছে, সে কার্যক্রমে তারা সফল। কিন্তু সার্বভৌম দেশে নিজের দেশের নাগরিককে বিনা বিচারে হত্যা কিংবা তার ওপর অনৈতিক অত্যাচার-নির্যাতন কি সত্যিই সফলতার লক্ষণ?

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০৫ জন গুম হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১০ বছর ধরে অজ্ঞাত স্থানে বন্দী থাকা ৮৬ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকাটিতে ছায়া বিরোধী দল বিএনপি, অন্যান্য মতাদর্শের রাজনৈতিক কর্মীসহ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা-বিহীন কিছু সাধারণ মানুষও আছে।

যে হারায়, সে আসলে কোথায় যায়? কবর বা নামফলক থাকে না, তবে কোথাও তো সে থাকে। কত বছর ধরেই না মানুষের মনে অজ্ঞাত স্থানটির আকার-আকৃতির কল্পনা এসেছে! তারপর এই প্রথম চিন্তায় এক অবয়ব ধরা দিয়েছে। হয়তো এমন একটা ঘর, এমনই একটা করিডরে কারও প্রিয়জনের চিৎকার গুমরে ফিরেছে, অশ্রুত হয়ে চাপা পড়েছে যান্ত্রিক পাখার কড়া শব্দের নিচে।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, কেউ বলল না এসব ভিত্তিহীন, এ ছবি মিথ্যা, এ কথা গুজব! না সরকার, না কোনো বাহিনী। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তারা কেউ এগিয়ে এসে এসব যে মিথ্যা, বানোয়াট, তার প্রচারে নামতে পারত। দুঃসহ যন্ত্রণায় যে সন্তান বেড়ে উঠছে, যে স্ত্রী কিংবা মা-বাবা তন্ন তন্ন করে খুঁজছে প্রিয়জনকে, তারা অন্তত ওই ঘুপচিঘরগুলো দেখে, নির্যাতনের বর্ণনা শুনে আপনজনকে সেখানে আটকে রাখার দুঃসহ কল্পনা থামাতে পারত। বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে আঙুল তোলার ধৃষ্টতায় তারা রেগে যেতে পারত, অন্তত নিজেদের নিরপরাধ প্রমাণের জন্য এগিয়ে আসত কেউ। নিজের দেশের বাহিনীকে এ সবকিছু মিথ্যা প্রমাণ করে তাদের একাত্তরের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে দেখলে জনগণের মাথা উঁচুই হতো।

কিন্তু তেমন ঘটে না; বরং বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদস্থ কারও কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘র‍্যাব আইনবহির্ভূতভাবে কিছু করে না। ক্রসফায়ারে এখন পর্যন্ত যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা সশস্ত্র, কুখ্যাত সন্ত্রাসী, ডাকাত ও জঙ্গি।’ অর্থাৎ এ পর্যন্ত ক্রসফায়ারে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের যেহেতু ঢালাওভাবে এক ছাঁচে ফেলা হয়, তাঁদের এ উপাধি নিয়েই মানুষের স্মৃতিতে থাকতে হবে—সশস্ত্র, কুখ্যাত সন্ত্রাসী, ডাকাত, জঙ্গি। প্রশ্ন হলো, বিচারের তোয়াক্কা না করে এ রকম মানুষদের কি সত্যিই চার ফুট দূর থেকে গুলি করে দেওয়া যায়? আর হতভাগ্য কারও অপরাধের গল্প প্রচারের মাধ্যমে ক্রসফায়ারই হোক কিংবা পুলিশি হেফাজতে, যেকোনো খুন কি জায়েজ হয়? কেবল দেশের বিচারব্যবস্থার দেউলিয়াপনা প্রকাশ্য হয়।

সোজা কথায় জানতে চাওয়া যেতে পারে, এই খুনের অধিকার তাদের কে দিল? ২০২০ সালে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করার পর এসআই আকবর যখন সীমান্তের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন খাসিয়াপল্লির যুবকেরা তাকে ঠিক এ রকম একটি প্রশ্নই করেছিল, ‘তুমি মারবার অধিকার পাইলা কই?’ সুযোগ বুঝে আগপিছ না ভেবে যুবকেরা উচ্চারণ করেছিল প্রশ্নটি, অথচ হায়, আজ আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ লোকেরা জানতে চাওয়ার সাহস করে উঠতে পারে না, তুমি মারার অধিকার পাইলা কই? তুমি গুমের অধিকার পাইলা কই?’

তবে এভাবে পিটিয়ে বা গুলি করে হত্যার ঘটনাকে সরকার যে একেবারেই অপরাধ মনে করে না, তা কিন্তু নয়; বর্তমান সরকার যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ‘সংবিধানপরিপন্থী’ বলে উল্লেখ করেছিল।

জানতে চাওয়া তো দূরের কথা, এখন লেখক-কবিসহ আরও বহু গুণীজন সামাজিক মাধ্যমে বা আড্ডার তোড়ে প্রকাশ্যেই বলেন, ক্রসফায়ারে তাঁদের সমর্থন আছে। সমাজের কোনো স্তর থেকে রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য আকস্মিক ফুঁড়ে বের হয় না, তাতে উচ্চপর্যায়ের ইন্ধন থাকে। দেশের মন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ সংসদ সদস্যদের মুখে শোনা গেছে, তাঁরা ক্রসফায়ার সমর্থন করেন। যে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যে মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যায়, তাদের বিচারবিহীন গুলি করে হত্যায় তাঁদের কোনো দ্বিমত নেই।

ক্রসফায়ারকে একটি স্বতঃসিদ্ধ শাস্তির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ধরে নিয়ে সে কারণে সরকারি দলের ও তথাকথিত বিরোধী দলের সংসদ সদস্য সংসদে দাঁড়িয়ে ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করতে পারেন। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলতে পারেন, ‘আমার যদি সুযোগ থাকত, আমি বলতাম এদের বিচারের কাঠগড়ায় নয়, সরাসরি ক্রসফায়ারে দিয়ে দিতে।’ যেখানে সমাজের উচ্চপর্যায়ের এই মতবাদ, সেখানে তুচ্ছ কারণে যোগাযোগমাধ্যমে কোনো অপরাধীর ক্রসফায়ারের দাবি ওঠা বিচিত্র নয়। এ রকম অবস্থায় সমাজের অন্য স্তর থেকে প্রতিবাদ বা যৌক্তিক চিন্তার অবকাশ নেই। অপরাধ উৎপাটনের নামে সরকার কর্তৃক অপরাধের প্রতিষ্ঠা তাই সমগ্র সমাজের মনস্তত্ত্ব বদলে দেয়।

তবে এভাবে পিটিয়ে বা গুলি করে হত্যার ঘটনাকে সরকার যে একেবারেই অপরাধ মনে করে না, তা কিন্তু নয়; বর্তমান সরকার যখন বিরোধী দলে ছিল, তখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে ‘সংবিধানপরিপন্থী’ বলে উল্লেখ করেছিল। এমনকি বিষয়টি সুস্থ সমাজে অগ্রহণযোগ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে নিজেদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ‘ক্ষমতায় গিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের অঙ্গীকার’ করেছিল।

কিন্তু হায়, যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ। বন্ধ করা তো দূরের কথা, বিরোধী মতের গলা টিপতে, নিজেদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, এ রকম কাউকে একনিমেষে উধাও করতে গুম আর বিচারবহির্ভূত হত্যাই হয়েছে হাতিয়ার। মানুষের মনে তার ব্যাখ্যাও সুন্দরভাবে অনেকাংশে বসানো হয়েছে—যারা মানুষকে ধ্বংস করছে, লাখ লাখ মানুষের নিরাপত্তা হরণ করছে, ক্রসফায়ার বা গুম তাদেরই পরিণতি এবং যৌক্তিক পরিণতি। হতভাগ্য মানুষগুলো যতই মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, মানবিক আচরণবঞ্চিত হোক না কেন, বুদ্ধিদীপ্ত ও সৃষ্টিশীল কতক মানুষও এ যুক্তি গ্রহণ করেছে।

তাই তো শিল্পমাধ্যমেও চলে এসেছে এর ব্যবহার। হাল আমলে চমৎকার নির্দেশনা, দর্শনীয় অভিনয়, কাহিনির অপূর্ব ঘোর আর শ্রুতিমধুর ডায়ালগসমৃদ্ধ ‘নিখোঁজ’ নামের একটি ওয়েব সিরিজে কত বিশ্বাসযোগ্যভাবেই না উপস্থাপন করা হলো যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গুম হওয়া মানুষ প্রকৃতপক্ষে ভয়ংকর অপরাধী। ট্রেইলার দেখে ‘গুম’ বিষয়ে অজানা কোনো তথ্য বেরিয়ে আসবে আশা নিয়ে দর্শক গুছিয়ে বসতে পারেন। তারপর মানবিক, রাজনীতি ও সমাজসচেতন ব্যক্তিমাত্রই বুঝবেন, সুস্বাদু পোলাও-কোর্মার সাজানো লোকমার অন্তরালে কত সহজে বিষ খাইয়ে দেওয়া যায়।

শিল্প-সাহিত্য যুগ যুগ ধরে সমাজের মননশীলতা তৈরি কিংবা যেকোনো সামাজিক আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। শিল্প-সাহিত্য পৃথিবীর প্রায় সব রাজনৈতিক আন্দোলনের আঁতুড়ঘর। অন্যদিকে, সমাজের চিন্তাশীল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাথায় ভ্রান্ত ধারণা আর ভুল ইতিহাস ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজেও হয়তো তাকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়। পুতুল বাহিনীর সুতা অন্য কারও হাতে—এ সত্যই যদি উদ্‌ঘাটন করা না যায়, তবে সাহস করার দরকারই কী গুম-খুনের বাস্তবতাকে শিল্প-সাহিত্যে ধরার! গুম-খুনের ঘটনাকে যৌক্তিকভাবে পেশ করার ভড়ং দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বহুল ব্যবহৃত গল্পের পুনরাবৃত্তি নিতান্তই হতাশাব্যঞ্জক ও সন্দেহজনক।

‘মায়ের ডাক’ বছর বছর আন্তর্জাতিক গুম দিবসে ডেকে যায়, ফিরিয়ে দিন, না হলে কবরটা চিনিয়ে দিন। কে শোনে কার কথা! ‘আয়নাঘর’ এর দেয়াল পুরু, যান্ত্রিক গোলযোগে ভরপুর, তাই ডাক পৌঁছায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা যখন প্রশ্নবিদ্ধ ও সমালোচিত, ঠিক তখনই হাতিরঝিল থানায় তরতাজা এক তরুণকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগ পাওয়া গেল। এই যে এ মুহূর্তেও কেউ হয়তো প্রিয়জনকে হন্যে হয়ে খুঁজছে, কেউ আর্তনাদ করছে বদ্ধ ঘরের মধ্যে, কারও প্রাণ ঝরে যাচ্ছে অকাতরে, নির্বিচারে, সবার অজান্তে।

  • আফসানা বেগম কথাসাহিত্যিক