নিষিদ্ধ করার পরও ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোশ্চেন তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী চলছে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়
নিষিদ্ধ করার পরও ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোশ্চেন তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী চলছে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়

কেন বিবিসির তথ্যচিত্র বিজেপির জন্য বিপজ্জনক

দুই সপ্তাহ ধরে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) রীতিমতো আতঙ্কিত বিবিসির একটি তথ্যচিত্র নিয়ে। তথ্যচিত্রে ব্রিটিশ সরকারের এক গোপন প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরাসরি ভূমিকা ছিল। ছবিটি ভারতে যাতে কোনোভাবেই দেখা না যায়—তা সুনিশ্চিত করেছে সরকার। বিষয়টা আশ্চর্যের। কারণ, বিজেপির বড় সমালোচকেরাও এই সময়ে মনে করেন না আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী দলকে হারানো সম্ভব। একদিকে বিরোধীরা জোটবদ্ধ হতে পারেননি, অন্যদিকে বিজেপির হাতে রয়েছে প্রভূত ক্ষমতা ও অর্থ। তাহলে সামান্য তথ্যচিত্র নিয়ে এত উদ্বেগ কেন? অনেক কারণ থাকলেও এখানে তিনটির ব্যাখ্যা করা যাক।

প্রথম কারণ ‘অ্যান্টি ইনকামবেন্সি’ বা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুব সুনির্দিষ্টভাবে এটা জানায় না, একজন নেতা কতটা জনপ্রিয়। কিন্তু একটা আন্দাজ দিতে পারে যে একজন নেতার জনপ্রিয়তা বাড়ছে না কমছে, বিশেষত সমাজের শিক্ষিত অংশের মধ্যে। ১০ বছর আগে টুইটারে নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে কী লেখা হতো, তা নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে প্রায় ১০০ শতাংশ মন্তব্যই ছিল তাঁর পক্ষে। বর্তমানে সাধারণ মানুষের বড় অংশ মোদির প্রধান সেনাপতিদের প্রবল আক্রমণ করছেন।

যেমন অমিত মালবিয়ার (যিনি বিজেপির প্রযুক্তিচালিত প্রচারের দায়িত্বে রয়েছেন) মন্তব্যে অসংখ্য টুইটার ব্যবহারকারী নিয়মিত কটূক্তি করছেন। মোদিপন্থী এক সম্পাদক সুধীর চৌধুরীকেও তাঁরা লাগাতার আক্রমণ করছেন। এ রকম উদাহরণ অসংখ্য। বিষয়টি সামান্য হলেও বিজেপির জন্য উদ্বেগের। কারণ, মধ্যবিত্তের মতো সামাজিক মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে। তাঁরা ক্রমাগত বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে, চাকরি-বাকরি কমছে। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হলো শেয়ারবাজারে মোদি–ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানির পতন এবং সংশ্লিষ্ট কেলেঙ্কারি। এ সবই সার্বিক প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার হাওয়া জোরালো করছে।

দ্বিতীয়ত, গত দুটি লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখা যাবে ভারতের মাত্র দুটি রাজ্য বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে ৩০ শতাংশের ওপরে আসন পেয়েছিল বিজেপি। এবারে বিহারে তাদের আসন কমার সম্ভাবনা; কারণ, এখন পর্যন্ত সেখানে দুই প্রধান বিজেপিবিরোধী দল লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল ও নীতীশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) একসঙ্গে সরকার চালাচ্ছে।

উত্তর প্রদেশেও বিজেপির অবস্থা সামান্য উদ্বেগের। কারণ, ২০২২-এর বিধানসভা নির্বাচনে তাদের আসন ৩১২ (২০১৭) থেকে কমে ২৫৫ হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনেও ৭১ (২০১৪) থেকে কমে হয়েছে ৬২ (২০১৯) আসন। অর্থাৎ ভারতের যে রাজ্যে সবচেয়ে বেশি আসন (৫৪৩-এর মধ্যে ৮০), সেখানে বিজেপির আসন কমছে। দক্ষিণ ভারতের পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে একমাত্র কর্ণাটক ছাড়া আর কোথাও বিজেপির অবস্থা ভালো নয়।

নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে যখন এই পরিবর্তন হচ্ছে, ঠিক তখনই বিবিসি গুজরাট দাঙ্গার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ২০ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই দাঙ্গার কথা অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের যাঁরা আগামী নির্বাচনে প্রথম ভোট দেবেন, তাঁদের জানার কথা নয়। ভারতে প্রথম ভোটারের সংখ্যা প্রায় ২ শতাংশ। তথ্যচিত্র তাঁদের সামনে তুলে ধরল নরেন্দ্র মোদির ভূমিকার কথা। এরপরও যদি বিজেপি তথ্যচিত্র দেখাতে দিত, তাহলে মেনে নিতে হতো যে ভারতের গণতন্ত্রের সঙ্গে উত্তর বা পশ্চিম ইউরোপের গণতন্ত্রের কোনো ফারাকই নেই। সেটা উপমহাদেশের রাজনীতিতে হতে পারে না, হয়ওনি।

বিজেপির জন্য যেটা বিশেষ উদ্বেগের, তা হলো অতীতের ভালো ফল। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে (যেখানে বিজেপির প্রধান ভোটব্যাংক রয়েছে) প্রতিটি বড় রাজ্যে প্রায় একাই বিজেপি বা তার শরিকেরা হয় সব আসন পেয়েছে অথবা দু–একটি কম পেয়েছে। সেখানে ‘পারফরম্যান্স’ আরও ভালো করার সুযোগ নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম মহারাষ্ট্র। এ অবস্থায় তিনটি প্রধান রাজ্য বিহার, উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে (গত নির্বাচনে ৪২-এর মধ্যে ১৮ আসন পেয়েছিল) কিছু আসন কমলেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় আসন (২৭২) বিজেপি এককভাবে পাবে কি না, বলা মুশকিল।

তৃতীয় কারণ দ্বিতীয়টির সঙ্গে যুক্ত। মুসলমান জনসংখ্যার নিরিখে ভারতের প্রথম ছয়টি রাজ্য হলো জম্মু কাশ্মীর, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, উত্তর প্রদেশ ও বিহার। ভারতের মোট ১৭ থেকে ১৮ কোটি মুসলমানের মধ্যে মোটামুটিভাবে ১২ কোটি এই ছয় রাজ্যে রয়েছেন। এর মধ্যে জম্মু–কাশ্মীরে আসনসংখ্যা খুব কম, আসামে প্রায় সব আসনই বিজেপির দখলে এবং পশ্চিমবঙ্গে বা কেরালায় খুব ভালো ফল করার সম্ভাবনা প্রায় নেই। অতএব পড়ে রইল বিহার ও উত্তর প্রদেশ; যেখানে ফল খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও, তা আটকানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। কারণ, এই দুই রাজ্যে হিন্দুত্ববাদের চিরাচরিত শক্তি প্রবল।

বিহার ও উত্তর প্রদেশে মুসলমান জনসংখ্যা যথাক্রমে ১৭ ও ২০ শতাংশ। অর্থাৎ মুসলমান সমাজের বড় ভোট রয়েছে এই দুই রাজ্যে। এদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া পসমন্দা মুসলমানের সংখ্যা ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। গত ১৭ জানুয়ারি, যেদিন বিবিসির তথ্যচিত্রের প্রথম পর্ব দেখানো হলো, সেদিনই পসমন্দা, বোহরা (ইসমাইলি শিয়া) এবং শিক্ষিত মুসলমানের মধ্যে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার কথা কর্মকর্তাদের বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। গত বছরের জুলাই মাসেও তিনি একই কথা বলেছিলেন।

বস্তুত এই লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)। ভারতের মুসলমান সমাজের শিক্ষিত অংশের প্রতিনিধিদের একটি দলের সঙ্গে সম্প্রতি তিন ঘণ্টা বৈঠক করেছেন আরএসএসের তিন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ইন্দ্রেশ কুমার, রাম লাল ও কৃষ্ণ গোপাল। মুসলমান সমাজের পক্ষে রাজনৈতিক, ধর্মীয় নেতা ও নাগরিক সমাজের কৃতী পেশাদারেরা এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সেই আলোচনায় খোলাখুলিভাবে প্রতিনিধিরা তাঁদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে মুসলমানদের ওপর শারীরিক হামলা, ঘৃণা উদ্রেককারী ভাষণ, বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু সমাজের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা থেকে মসজিদ সরানোর জন্য হিন্দু সংগঠনের আইনি পদক্ষেপের বিষয় উঠে আসে বলে ভারতের অন্যতম বৃহৎ ইসলামি সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ আধিকারিক মালিক মোহতাসিম খান জানিয়েছেন।

আরএসএসের নেতারা, তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো ব্যাখ্যাও করেছেন। যদিও অতীতে আরএসএস ইসলামি সংগঠনের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে, কিন্তু বর্তমান ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে এটা প্রায় বৈপ্লবিক একটা ঘটনা যে হিন্দু রাষ্ট্রের আদর্শে বিশ্বাসী সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য সংগঠনের কাছে নিজেদের নেতা-কর্মীদের সমালোচনা শুনছেন।

এই নতুন রাজনীতির ব্যাখ্যা কীভাবে করা যাবে? পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, নিজেদের শক্তির জায়গায় আসন বৃদ্ধির আর সম্ভাবনা না থাকায় এবং বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে আসন কমার আশঙ্কাতেই দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলমান সম্প্রদায়ের ভোট (১০০ লোকসভা আসনে ২০ শতাংশ বা তার ওপরে মুসলমান ভোট রয়েছে) টানতে বা তা একাধিক দলের মধ্যে ভাঙতেই এই কৌশলী পরিবর্তন। তবে মনে রাখা প্রয়োজন, বিভিন্ন সমীক্ষার বিচারে নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা ভারতে এখনো অটুট। তারপরও বিজেপি যে কৌশলী পরিবর্তন আনছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে তারা কত সাবধানী দল। এই সাবধানতাই তাদের সাফল্যের প্রধান কারণ।

নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে যখন এই পরিবর্তন হচ্ছে, ঠিক তখনই বিবিসি গুজরাট দাঙ্গার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ২০ বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই দাঙ্গার কথা অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের যাঁরা আগামী নির্বাচনে প্রথম ভোট দেবেন, তাঁদের জানার কথা নয়। ভারতে প্রথম ভোটারের সংখ্যা প্রায় ২ শতাংশ। তথ্যচিত্র তাঁদের সামনে তুলে ধরল নরেন্দ্র মোদির ভূমিকার কথা।

এরপরও যদি বিজেপি তথ্যচিত্র দেখাতে দিত, তাহলে মেনে নিতে হতো যে ভারতের গণতন্ত্রের সঙ্গে উত্তর বা পশ্চিম ইউরোপের গণতন্ত্রের কোনো ফারাকই নেই। সেটা উপমহাদেশের রাজনীতিতে হতে পারে না, হয়ওনি।

শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা