‘এই বেতমিজ মেয়েটাকে শিক্ষা দেওয়া দরকার’—কথাগুলো শুনেছিলাম যখন ইমরান খান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ইসলামাবাদ পুলিশ এই 'বেতমিজ মেয়ে', মানে, ইমান মাজারির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইসলামাবাদের জাতীয় প্রেসক্লাবের বাইরে বেলুচ শিক্ষার্থীদের এক বিক্ষোভে তিনি নাকি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন।
ইসলামাবাদের কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলুচ ছাত্রদের অভিযোগ ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহায়তায় একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তাঁদের হুমকি দিচ্ছেন। ওই কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর কয়েকজন বেলুচ ছাত্র নিখোঁজ হয়ে যান। তাই বেলুচ ছাত্রদের একটাই দাবি ছিল যে আমরা যদি কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকি, তাহলে আমাদের পড়াশোনা করতে দেওয়া হোক।
ইমান তাদের পক্ষে ইসলামাবাদ হাইকোর্টে একটি পিটিশনও দাখিল করেন, যাতে এই শিক্ষার্থীদের বেলুচ পরিচয়ের কারণে ভয় দেখানো বন্ধ করা হয়। এর পাল্টা ইমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা হয়। আমি যখন ইমানের বিরুদ্ধে করা মামলা নিয়ে লিখলাম যে এটা আইনের অপব্যবহার। তখন রাষ্ট্রীয় সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে বললেন, ‘এরই মধ্যে আপনার ওপর ৯ মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। ইমানকে সমর্থন করে তো আপনি বিপদ বাড়াচ্ছেন।’
আমি বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলাম যে নিষেধাজ্ঞা পেয়ে আমি যে স্বাধীন বোধ করছি, নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে তা আর পাব না। তিনি বিনীতভাবে অনুরোধ করলেন, ‘বিদেশি সংবাদমাধ্যমে ইমানকে সমর্থন করবেন না, প্লিজ, মেয়েটা খুব ঝামেলায় ফেলেছে।’ আমি বললাম, ইমানের মা ড. শিরিন মাজারি তো মন্ত্রী, তিনি কিছু বলছেন না? উত্তর এল, এ বিষয়ে তিনিও অসহায়।
সে সময়ের সেনাপ্রধান সাংবাদিকদের সুরক্ষা এবং নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারের জন্য যে আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন, তাতে শিরিন সন্তুষ্ট ছিলেন না। আমি ওই কর্মকর্তাকে বললাম যে ইমান মাজারি নিখোঁজ সাংবাদিক মুদাসসার নারোর মায়ের আইনজীবী। তাই আমি ইমানের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় মামলার নিন্দা করতে আমি কসুর করব না। আমার কথা শুনে কর্মকর্তা বাতাসে আঙুল নাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘মির স্যার, দেখবেন, এই অসভ্য মেয়েটাকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।’
কয়েক দিন পর পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার ঘোষণা দেওয়া হয়। সরকারের রাজনৈতিক সন্ত্রাস অর্ধেকে নেমে আসে। আমার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞাও শেষ হয়। কিন্তু শুরু হয় রাজনৈতিক কর্মী ও সাংবাদিকদের আটক করা।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পাল্টে গেল। যাঁরা আমার ওপর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে ছিলেন, তাঁরাই নতুন সরকারের শাসনামলে নিষেধাজ্ঞার শিকার হতে লাগলেন। তাঁরা আমার কাছে সাহায্যের জন্য আসতেন আর আমি তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া শুরু করলাম ইমানের কাছে।
ইমান মাজারি নামের বেতমিজ মেয়েটার নামে তেহরিক–ই–ইনসাফের শাসনামলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়েছিল। এখন তেহরিক–ই–ইনসাফের সমর্থকেরা সেই বেয়াদব মেয়েটার কাছে সাহায্য চাইছে।
ইমান মাজারির মা শিরিন মাজারির রাজনৈতিক আনুগত্য পরিবর্তন করতে চাপ দেওয়ার জন্য মামলা দেওয়া হলো। সেই মামলায় জামিন পেলেও অন্য মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ইমানকে গ্রেপ্তার করার পর শাহবাজ নিজের বুকে যে পদক ঝুলিয়েছেন, তাকে বলে কুখ্যাতির পদক। আর গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে ইমানকে যে পদক দেওয়া হলো, তাকে বলে ন্যায়পরায়ণতার পদক। শাবাশ ইমান, শাবাশ হাদি।
এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইমান কড়া মন্তব্য করলেন জেনারেল বাজওয়া সম্পর্কে। ২০২২ সালের ২৬ মে ইমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা করার বিষয়টি আদালতে পৌঁছালে ইমানের আইনজীবী জেনারেল বাজওয়া সম্পর্কে বলা কথার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। মামলার আইনি ভিত্তি খুবই দুর্বল ছিল।
২০২২ সালের নভেম্বরে জেনারেল বাজওয়া অতীতের জিনিস হয়ে গেলেন। কিন্তু ইমান মাজারির অপকর্মের শেষ নেই। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, ইমানকে পশতুন সুরক্ষা আন্দোলনের সমাবেশে বক্তৃতার অপরাধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো। এ মামলায় জামিন মঞ্জুর হওয়ার পরই সন্ত্রাসের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
সেই মামলা থেকে মুক্তির পর ইমান মাজারি তাঁর সহকর্মী আইনজীবী হাদি আলী ছাট্টাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ইমানের সংসর্গে পড়েন হাদিও। একদিন সকালে স্বামী-স্ত্রী দুজনই আদালতে যাচ্ছিলেন। সে সময় ভিআইপি চলাচলের কারণে রাস্তা ছিল বন্ধ। দুজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তর্কাতর্কি শুরু করেন। স্বামী-স্ত্রী এবার আটক হলেন সহিংসতা আর সন্ত্রাসের মামলায়।
তবে সবাই তাঁদের আসল অপরাধের কথা জানে। তাঁদের আসল দোষ, কখনো এক বেতমিজ কবি আহমেদ ফরহাদের আইনজীবী হওয়া। কখনো বেতমিজ সাংবাদিক আসাদের পক্ষে, কখনো মাহরং বেলুচের পক্ষে আবার কখনো আলী উজিরের পক্ষে উকিল হওয়া। ইমান ও হাদি ভাগ্যবান যে নিপীড়িতদের ভালোবাসা তাঁদের সঙ্গে আছে। ট্র্যাজেডি হলো, ইমরান খানের শাসনামলেও ইমানকে বিশ্বাসঘাতক ও সন্ত্রাসী বলা হতো। আর এখন শাহবাজ শরিফের শাসনামলেও তেমনটি বলা হয়। ইমানকে গ্রেপ্তার করার পর শাহবাজ নিজের বুকে যে পদক ঝুলিয়েছেন, তাকে বলে কুখ্যাতির পদক। আর গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে ইমানকে যে পদক দেওয়া হলো, তাকে বলে ন্যায়পরায়ণতার পদক। শাবাশ ইমান, শাবাশ হাদি।
হামিদ মির পাকিস্তানের সাংবাদিক
জংগ থেকে নেওয়া, উর্দু থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন