সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রযুক্তি কতটা সহায়ক

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহারকে অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। নির্বাচন অনুষ্ঠান ও পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে জনমনে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ও সংশয় আছে। সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার একটি সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা, প্রযুক্তির ব্যবহার নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে নিখুঁত করতে এবং বিশ্বস্ত নির্বাচন পরিচালনা করতে সাহায্য করতে পারে। কয়েকটি উপায়ে নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে।

প্রথমত, প্রায়ই বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে গোলযোগ দেখা যায়, যার কারণে কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে এবং এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। এই বিষয়ে প্রায়ই বিভিন্ন অভিযোগ আসে, কিন্তু সঠিক প্রমাণাদির অভাবে এর কোনো যথাযথ সমাধান করা যায় না। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার জন্য যদি প্রযুক্তিগত ব্যবহার বাড়িয়ে দৃশ্যমান কিছু পরিবর্তন আনা যায়, তবে এই সমস্যার অনেক ক্ষেত্রেই সমাধান করা সম্ভব।

এই ক্ষেত্রে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে যদি সিসিটিভি ক্যামেরা প্রতিস্থাপন করা হয়, তবে এটি একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে। গোলযোগের পরিকল্পনাকারীদের জন্য এটি একটি বাধা হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়া যদি কোনো গোলযোগ হয়ে থাকে, তবে তার সঠিক প্রমাণাদি থেকে যাবে। এর মাধ্যমে যেকোনো ধরনের অভিযোগ খতিয়ে দেখার জন্য একটি সুদৃঢ় প্রমাণ তৈরি হবে।

একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় সিসিটিভি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা হলে যখনই এ ধরনের কোনো গোলযোগের খবর পাওয়া যায়, তৎক্ষণাৎ সেখানে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হবে এবং প্রয়োজনে ভোট কার্যক্রম স্থগিত করা যাবে, যেমনটা ২০২২ সালে ভোটে অনিয়মের অভিযোগে গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) উপনির্বাচনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছিল।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মতো উদ্ভাবনী সমাধানগুলো ব্যবহার করে, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে—এ রকম দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর সমাধান করা যেতে পারে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো ধাপই ব্যয়বহুল নয়। বাংলাদেশের কাছে তার সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে তার নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করার সুযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করা সম্ভব হবে।

দ্বিতীয়ত, ভোট গণনা নিয়েও নানা ধরনের সংশয় ও সন্দেহ আছে। ভোট গণনার সময় অবশ্যই পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন। যখন ভোটকেন্দ্রে ভোট গণনার প্রক্রিয়া চলমান, তখন যদি ভোট গণনা একটি বড় মনিটরের মাধ্যমে কেন্দ্রের বাইরে উপস্থিত জনগণের কাছে দৃশ্যমান করা যায়, তবে ভোট গণনার স্বচ্ছতা বহাল থাকবে। কারণ, সব দল এবং সাধারণ জনগণ প্রক্রিয়াটি পরিদর্শন করতে পারবেন। এর মাধ্যমে ভোট গণনায় কারচুপি প্রতিহত করা সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। ভোট গণনা সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিয়েল-টাইম আপডেট সবাইকে সর্বশেষ ফলাফল সম্পর্কে অবগত থাকতে সহায়তা করে। দৃশ্যমান ভোট গণনা নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়ায়। ভোটার, প্রার্থী ও পর্যবেক্ষকেরা গণনাপ্রক্রিয়াটি সরাসরি প্রত্যক্ষ করতে পারেন, যা কারচুপি বা জালিয়াতির সন্দেহ কমাতে পারে।

তৃতীয়ত, দেখা যায় যে ভোটকেন্দ্রে ভোট গণনার পর যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা পরবর্তী সময় যখন অন্যান্য স্তরে ভোট বাক্স পাঠানো হয় এবং সেখানে যখন ট্যাবুলেশন করা হয়, তখন অধিকাংশ সময় হেরফের পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার জন্য যদি প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটের সংখ্যা কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইটে লিপিবদ্ধ করা যেতে পারে, তাহলে এর মাধ্যমে ভোট গণনায় কারচুপি প্রতিহত করা সম্ভব। গণনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইটটি তাৎক্ষণিকভাবে আপডেট করা যেতে পারে, যা প্রথাগত রিপোর্টিং পদ্ধতির ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত সময়ের ব্যবধান দূর করতে পারে। এই তাৎক্ষণিকতা সর্বশেষ তথ্য সম্পর্কে সবাইকে অবগত রাখবে।

অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভোটকেন্দ্রে গোলযোগ হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎক্ষণাৎ জানানো সম্ভব হয় না। এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার জন্য কেনিয়ায় নির্বাচন পরিচালনা করার ক্ষেত্রে উসাহিদি নামে একটি সফটওয়্যার আবিষ্কার করা হয়, যার আদলে আমাদের দেশেও একটি সফটওয়্যার দাঁড়া করানো যেতে পারে। এর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে দ্রুত ও তাৎক্ষণিক যোগাযোগ সম্ভবপর হয়ে উঠবে।

নির্বাচনে জালিয়াতি শনাক্তকরণের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী পদ্ধতি হতে পারে। অ্যালগরিদমগুলোকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণের ধরনগুলো শনাক্ত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে সম্ভাব্য জালিয়াতি প্রতিহত করা সহজতর হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অস্বাভাবিক ভোটদানের ধরনগুলোকে শনাক্ত করতে পারে, যেমন একটি নির্দিষ্ট স্থানে একটি নির্দিষ্ট প্রার্থীর জন্য অস্বাভাবিকভাবে বেশিসংখ্যক ভোট গণনা হলে তা অতি দ্রুত পরিলক্ষিত ও শনাক্ত হবে। ভোটার তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে এবং মিথ্যা পরিচয় শনাক্ত করতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অন্যান্য সরকারি ডেটাবেজের সঙ্গে ভোটার নিবন্ধন ডেটাবেজগুলোকে ক্রস-চেক করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

এ ছাড়া দেখা যায় যে অধিকাংশ সময়ে ব্যালট পেপারকে ব্যাপকভাবে অসদুপায়ে ব্যবহার করা হয় ও হেরফের করা হয়। সে ক্ষেত্রে যদি প্রত্যেক ভোটারের ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করা হয়, তবে মৃত ব্যক্তির ভোট গণনার মতো জালিয়াতিকে মোকাবিলা করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ফিঙ্গার প্রিন্ট কেন্দ্রীয় ডেটাবেজের সঙ্গে সংযুক্ত করা যেতে পারে, অথবা আরও সক্রিয় করার জন্য জেলাভিত্তিক ডেটাবেজের সঙ্গে সংযুক্ত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ভোট গণনায় স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য ব্লকচেইনের ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রতিটি ভোট ও লেনদেন ব্লকচেইনে রেকর্ড করা যেতে পারে, এটি নিশ্চিত করে যে একবার ডেটা প্রবেশ করা হলে নেটওয়ার্ক থেকে সম্মতি ছাড়া এটি পরিবর্তন বা মুছে ফেলা যাবে না। ব্লকচেইন নির্বাচনের ফলাফল নিরাপদে প্রেরণ এবং সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি ট্রান্সমিশনের সময় ফলাফল বাধা বা পরিবর্তিত হওয়ার ঝুঁকি দূর করে। বিশ্বে প্রথমবারের মতো সিয়েরা লিওনে (২০১৮ সালের ৭ মার্চ) একটি ব্লকচেইনভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়।

জনগণের কাছে নির্ভুল, নিরপেক্ষ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যমের উচিত নিরপেক্ষ প্রতিবেদনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। সাংবাদিকদের উচিত কোনো বিশেষ প্রার্থী বা দলের পক্ষপাতিত্ব না করে সুষ্ঠুভাবে তথ্য উপস্থাপন করা। ভুল তথ্যের বিস্তার রোধ করার জন্য তথ্যের সত্যতা যাচাই অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনের পরিসংখ্যানের ওয়েবসাইটের সঙ্গে হয় গণমাধ্যম সংযুক্ত থাকবে, অথবা গণমাধ্যম তাদের প্রয়োজনে এই পরিসংখ্যান সেখান থেকে যাচাই–বাছাই করে নিতে পারবে। সব ক্ষেত্রেই ফ্যাক্ট চেকের ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে সঠিক পরিসংখ্যান ও তথ্য সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মতো উদ্ভাবনী সমাধানগুলো ব্যবহার করে, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে—এ রকম দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর সমাধান করা যেতে পারে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো ধাপই ব্যয়বহুল নয়। বাংলাদেশের কাছে তার সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে তার নির্বাচনী ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করার সুযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করা সম্ভব হবে।

মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ