আমাদের প্রযুক্তির রেলগাড়ি কেন লাইনে থাকছে না

তৈরি পোশাক আর জনশক্তি রপ্তানির বাইরে আমাদের বাকি যেসব খাত থেকে বড় ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম তথ্যপ্রযুক্তি খাত। কথা ছিল, ২০২১ সালের মধ্যে এই খাতে ৫০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আসবে। বৈদেশিক মুদ্রা যেখানে থাকার, সেখানে থাকলেও পরিবর্তন হয়েছে কথার। ২০২১-এর বদলে এখন ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০০ কোটি ডলার রপ্তানির আয়ের লক্ষ্য।

বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ, বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও চাহিদা বিবেচনায় নিলে ৫০০ কোটি ডলার বাস্তবসম্মত লক্ষ্য। তবে অনুশীলন না করে শুধু গায়ের জোরে ডাউন দ্য উইকেটে এসে ব্যাট চালালেই যেমন ক্রিকেট ম্যাচ জেতা যায় না, তেমনি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না করে শুধু সভা-সমাবেশ করে বারবার ৫০০ কোটি ডলার বলতে থাকলেই সেটি অর্জিত হয়ে যাবে না।

দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্ট বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসোসিয়েশন, তথা বাণিজ্য সংগঠন আছে। এর মধ্যে যৌথ কিছু কর্মকাণ্ডে পাঁচটি সংগঠনের (পঞ্চপাণ্ডব) উপস্থিতি দেখা যায় এবং এই খাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন এই পাঁচ সংগঠন। এতে আছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস), ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্টাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্কো), বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস) এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)। কিছুদিন আগে সংসদে এটুআই বিল ২০২৩ পাস হওয়ার পর নিজেদের কিছু দাবি পূরণ না হওয়ায় যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছিল এই পাঁচ বাণিজ্য সংগঠন।

প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার পর এই সংগঠনগুলো থেকে মতামত দেওয়ার আওয়াজ ওঠে। একটি দেশের ভিশন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’, অথচ ডিজিটাল-সংশ্লিষ্ট খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনগুলোকে মতামত দিয়ে বলতে হয়, দেশের ভিশনের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বাজেট কিংবা ভ্যাট-ট্যাক্স নীতির সামঞ্জস্য নেই। বাজেটের আগে প্রথাগতভাবে এই সংগঠনগুলোর কাছ থেকে মতামত চাওয়া হয়, অনেক ক্ষেত্রে লিখিত মতামত দিতে বলা হয়। কিন্তু সেই মতামতের প্রতিফলন কি আদৌ কিছু হয়?

আমাদের নীতিনির্ধারকেরা খুব গুরুত্বসহকারে অংশীজনদের মতামত প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। এরপর সংবাদ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামত চাওয়া পর্যন্ত সত্য। কিন্তু সে মতামত যে উপেক্ষা করা হয়, মতামতের প্রতিফলন যে সিদ্ধান্তের মধ্যে থাকে না, সেটি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। কী কারণে মতামত গ্রহণ বা বর্জন করা হলো, তা অংশীজনদের জানার অধিকার আছে এবং সংগঠনগুলো সেটি দাবি করতে পারে।

আমাদের নীতিনির্ধারকেরা খুব গুরুত্বসহকারে অংশীজনদের মতামত প্রদান অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। এরপর সংবাদ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অংশীজনদের মতামত চাওয়া হয়েছে। মতামত চাওয়া পর্যন্ত সত্য। কিন্তু সে মতামত যে উপেক্ষা করা হয়, মতামতের প্রতিফলন যে সিদ্ধান্তের মধ্যে থাকে না, সেটি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। কী কারণে মতামত গ্রহণ বা বর্জন করা হলো, তা অংশীজনদের জানার অধিকার আছে এবং সংগঠনগুলো সেটি দাবি করতে পারে।

অন্যদিকে এই সংগঠনগুলো ব্যাপক ভূমিকা রাখার কথা নীতিমালা তৈরিতে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে শুধু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নীতিমালায় সুপারিশ যোগ করার প্রবণতা দেখা যায়। অভিজ্ঞতা অবশ্যই কাজে লাগবে, কিন্তু সংগঠন থেকে সুপারিশগুলো আসতে হবে পর্যাপ্ত স্টাডি ও ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে। সে সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে তার প্রভাব কী হবে, সেটির ধারণাও দিতে হবে, যেন সুপারিশগুলো যে যথার্থ ছিল, পরবর্তী সময়ে সেটির প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও সংগঠনগুলোর প্রতি একধরনের আস্থা তৈরি হয়।

এটি ঠিক যে সংগঠনগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু সেটিতে কাজ কি হচ্ছে? কাজের অগ্রাধিকারও কি নতুনভাবে নির্ধারণ করার সময় হয়েছে? ক্রমান্বয়ে সংগঠনগুলো কি ইভেন্ট ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে যাচ্ছে? মেলা, সামিট আর সম্মেলন ব্যবস্থাপনাই কি ফোকাস হয়ে পড়ছে? আমরা এখন অনলাইন কেনাকাটার মাধ্যমে চীন দেশ থেকে সহজে পণ্য ক্রয় করতে পারি, কিন্তু কেন সহজে চীনের ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারি না?

একাধিক সাবমেরিন কেব্‌ল থাকলেও ব্যান্ডউইডথের জন্য আমাদের কি অন্য উৎসের প্রতিই ঝুঁকতে হবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে বিপিও খাতে ভাগ বসাতে যাচ্ছে, সে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের পরিকল্পনা কী—রয়েছে এ রকম নানা রকমের প্রশ্ন, যেগুলো নিয়ে এই সংগঠনগুলোরই কার্যকরভাবে সোচ্চার থাকার কথা।

অনানুষ্ঠানিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানি আয় বর্তমানে বছরে ১৫০ কোটি ডলার ধরা হয়। তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আয় আগের বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ কমে ৫৪৮ দশমিক ১০ মিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। অথচ ২০২৫ সালের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এটি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা।

এই রপ্তানি আয় কমার পেছনে আমরা অনেক যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেললেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ভারতের রপ্তানি আয় কয়েক শতাংশ বেড়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছেছে। অতএব, এটি স্পষ্ট যে প্রথাগত প্রচেষ্টায় কাজ হচ্ছে না; আমাদের প্রযুক্তির রেলগাড়ি লাইনে থাকছে না।

স্বীকার করি, এই লাইনচ্যুতির দায়ভার শুধু সংগঠনগুলোর নয়; দায়ভার সবার, দায়ভার আমাদেরও। আমরাও নিশ্চয় আমাদের অংশটুকু করছি না, দায়িত্বটুকু ঠিকমতো পালন করছি না। কিন্তু কারণ সে যা-ই হোক, সেটি খুঁজে বের করার কাজটুকু সংগঠনগুলো করতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি খাত ভালো না থাকলে, তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত লাখ লাখ মানুষ ভালো থাকবে না।

● ড. বি এম মইনুল হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক

bmmainul@du.ac.bd