মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা কঠিনতর হচ্ছে

অন্তত ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়নি বা ১০ শতাংশের নিচেই রয়েছে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার। আপাতত এই সান্ত্বনা নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ হয়েছে। অন্যভাবে বললে, নতুন ২০২৪-২৫ অর্থবছর শুরু হয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বোঝা নিয়ে, যা শিগগিরই নেমে আসবে, সে সম্ভাবনা কম। সরকার অবশ্য আশাবাদী যে অর্থবছর শেষে এই হার অনেকটাই কমবে। বাজেটে অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরে পৌনে ৭ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। বিপরীতে মূল্যস্ফীতির বার্ষিক গড় হার সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে চান তিনি।

বাজেট পেশের দিন প্রদত্ত বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গিয়ে চরম ভোগান্তির বিষয়টি খোলাখুলি স্বীকার করেছেন। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ায় লাগাম টানার জোর প্রয়াস চালাতে তাঁর সদিচ্ছাও প্রকাশিত হয়েছে। আবার বাজেট অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে তিনি মূল্যস্ফীতি প্রশমনের লড়াইয়ে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিকে হাতিয়ার হিসেবে বহাল রাখার বিষয়ে কিছুটা অনীহা প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, এতে অদূর ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির হার কিছটা শ্লথ হয়ে পড়তে পারে। 

অর্থমন্ত্রীর এই মনোভাবকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কোন বার্তা হিসেবে নেবেন? কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো এখন অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের মুদ্রানীতি তৈরিতে ব্যস্ত, যেখানে এই সময়কালে ঋণপ্রবাহ তথা বাজারে টাকার জোগান কী হারে এবং কতটা বাড়ানো হবে, তার পরিকল্পনা থাকবে।

গত অর্থবছর শেষ হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ হারে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি নিয়ে। এখন থেকে ১২ মাসের মাথায় তা ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামাতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান করণীয় হলো সুদের হার বাড়ানো; যেন বাজারে টাকার সরবরাহ কমে আর মানুষের হাত থেকে টাকা যেন ব্যাংকে গিয়ে ঢোকে। পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় ও শিল্পকারখানায় উৎপাদন বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ যেন করা যায়, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। 

সুদের হার বাড়লে উৎপাদন ও ব্যবসার খরচ তো কিছুটা বাড়বেই। কারণ, ব্যাংক থেকে আগের চেয়ে একটু উঁচু হারের সুদে ঋণ নিতে হবে। তাতে কেউ কেউ নিরুৎসাহিত হতে বাধ্য হবে, ঋণ নেওয়া কমিয়ে দেবে বা নেবেই না। এতে আবার বাজারে টাকার সরবরাহ কিছুটা কম থাকবে। ফলে একটা পর্যায়ে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে আসবে, যা সবারই কাম্য। অন্তত অর্থনীতির তত্ত্ব তাই বলে আর পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবেই মূল্যস্ফীতিকে বশে নিয়ে আসে। 

বাংলাদেশে বছরখানেক ধরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রয়োগ করে তথা সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি সংযত করার চেষ্টা চলছে। আপাতদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে এই প্রয়াস এখনো পর্যাপ্ত সাফল্য আনেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ডিসেম্বরের মধ্যে রেপোর হার মানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে ঋণ দেওয়ার বিপরীতে যে সুদ নির্ধারিত হয়, তার হার বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করতে বলেছে। এ বছর মে মাসেই বাংলাদেশ ব্যাংক এটা বাড়িয়ে সাড়ে ৮ শতাংশে তুলেছে আর এটাই এখন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান নীতি হার, যার বাড়া-কমা থেকে ব্যাংকগুলো বুঝে নেয় তাদেরকে ঋণ ও আমানতের সুদের ক্ষেত্রে কোন দিকে যেতে হবে।

তবে মূল্যস্ফীতি কমানোর লড়াইটা অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য সামনে আরেকটু কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে আর তা বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির চলমান প্রবণতার কারণে। দুই বছর আগে বিশ্বের ১৯৪টি দেশের মধ্যে ১৭৯টি দেশে মূল্যস্ফীতির বড় উল্লম্ফন ঘটে আর যুক্তরাষ্ট্র ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে মূল্যস্ফীতির দেখা পায়। এর পর থেকে বিভিন্ন দেশের মূল্যস্ফীতির গতি শ্লথ হয়ে এলেও অনেক বাজারে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দাম সেভাবে কমেনি। গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনে দুই মাসে আগে এক নিবন্ধে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘ভোক্তা মূল্যসূচক পুরো গল্পের অংশবিশেষ মাত্র।’ 

এখন মূল্যস্ফীতি শ্লথ হয়ে আসার যে প্রবণতা দেখা দিচ্ছে, তাতে করে যা হবে বা হতে যাচ্ছে, তা হলো মূল্যস্ফীতির গতি কমে যাবে বা ভোক্তামূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে না, বাড়বে ধীরগতিতে। এতে ভোক্তারা বাজারে বেশির ভাগ পণ্যই আর দু–তিন বছর আগে যে দামে কিনতে পেরেছিলেন, তা পারবেন না।

গ্লোবাল ফাইন্যান্স বলছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় কোভিড-পরবর্তী চলমান সময়ের কিছু অভূতপূর্ব অবস্থা দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতির দুরবস্থার জন্য অল্প কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বাজারের ওপর বিপুল প্রভাবকে অন্যতম কারণ হিসেবে অভিহিত করে নিবন্ধটিতে আরও বলা হয়েছে যে অনেক প্রতিষ্ঠানই মূল্যস্ফীতিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে পণ্যের দাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ‘ভোক্তার পছন্দের ওপর আধা-একচেটিয়া (সেমি-মনোপলিস্টিক) নিয়ন্ত্রণ রেখে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করতে পারে,’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে এতে।

বাংলাদেশের অবস্থাও কি অনেকটা এ রকম হয়ে পড়েনি?

আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক

asjadulk@gmail.com