মতামত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে এত শিক্ষার্থী ফেল করল কেন

প্রচলিত নিয়ম ভেঙে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের একটি উদ্যোগ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্প্রতি সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর পরীক্ষার উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটিকে কিছু অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর চাপের মুখে প্রশাসনের নীতি স্বীকার বলে বিবেচনা করছেন কেউ কেউ। এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের জন্য একটি বাজে নজির বলেও মনে করেন তাঁরা।

ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় (২০২১-২০২২) অংশ নিয়েছিলেন ১১৭ জন। তার মধ্যে ফেল করেছেন ৩৯ জন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিভাগের কিছু শিক্ষক উত্তরপত্রের অবমূল্যায়ন করেছেন বলে এত বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থী ফেল করেছেন।

শিক্ষার্থীদের এই দাবির যৌক্তিকতা খুঁজতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। সরল দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত নমুনা যাচাই করে তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হয়েছে যে স্নাতকোত্তর ২০২১ বর্ষের ফলাফল শতভাগ নির্ভুল। ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের কোনো যৌক্তিকতা নেই, উপরন্তু তা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মন্তব্য করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।

কিন্তু তদন্ত কমিটির এসব মতামত আমলে নেয়নি সিন্ডিকেট। এক জরুরি সভায় পরীক্ষাটির ফলাফল বাতিল করে পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়। গঠন করা হয় নতুন একটি কমিটিও। 

এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্ষুব্ধ ওই শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান। তদন্ত কমিটি যেখানে তাঁদের সততা বা দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি, সে ক্ষেত্রে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য আরেকটি কমিটি গঠন তাঁদের জন্য অবমাননাকর বলে মনে করেন এই শিক্ষক। তিনি উপাচার্যের কাছে লেখা এক চিঠিতে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এবং নবগঠিত কমিটি বাতিল চেয়েছেন।

সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্তে যে যথেষ্ট যুক্তির জোর ছিল না, তার বড় প্রমাণ, এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার বলেছেন, ‘এটাকে বিশেষ কেস (ঘটনা) হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এটিকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো যাবে না।’ যে সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের উদাহরণ হিসেবে গৃহীত হয় না, সেটি কি দুর্বল সিদ্ধান্ত নয়? 

এবার অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বলা যাক। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া হয়, কলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় থাকা অগ্রগামীদের অন্যতম পছন্দের বিষয় থাকে ইংরেজি। কিন্তু আমরা তো জানি, উচ্চমাধ্যমিকে যেটুকু ইংরেজি পাঠ নেন একজন শিক্ষার্থী, সেই সম্বল ইংরেজি সাহিত্য পাঠের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথম বর্ষেই এসব ছাত্রছাত্রীর ফলাফল আশানুরূপ হয় না। পরবর্তী বছরগুলোতেও এই ঘাটতি থেকে যায় অনেকের। 

ভাবতে হবে, যে শিক্ষার্থী ৩৮-৩৯ পেয়ে ফেল করলেন, তাঁর সঙ্গে যে শিক্ষার্থী ৪০ পেয়ে পাস করলেন, তাঁর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য করা যায় কি না। কিংবা যে শিক্ষার্থী ৫৯ নম্বর পেয়ে বি মাইনাস পেলেন, তাঁর সঙ্গে ৬০ নম্বর পেয়ে বি পাওয়া শিক্ষার্থীর পার্থক্য কতটুকু, বিশেষত সাহিত্য ও তত্ত্বীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে? 

বছর দুই আগে থেকে প্রতি ১০০ নম্বরের কোর্সে উপস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের জন্য ৩০ নম্বর বরাদ্দ রাখায় পরীক্ষার ফলাফলে উন্নতি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পুরোনো পন্থায় থাকা ব্যাচগুলো এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত। প্রশ্ন আসে, পাঁচ বছরের কোর্স সাত-আট বছরে শেষ করে বড় সংখ্যার স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ফেল করা কতটা স্বাভাবিক? এখানে কি শিক্ষকদের দায় নেই?

বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ক্লাস না নেওয়ার অভিযোগ তুলনামূলক বেশি। আগেই বলেছি, ইংরেজি বিভাগে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেন তুলনামূলক মেধাবী শিক্ষার্থীরা। সুতরাং তাঁদের ফলাফল বিপর্যয়ের দায় পুরোপুরি এড়াতে পারেন না শিক্ষকেরা। নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ যে সম্পর্কিত, এ কথা কজন শিক্ষক মনে রাখেন জানি না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে বাড়তি উপার্জনের অভিযোগও তো পুরোনো। 

পরীক্ষায় ভালো-মন্দ ফলের দায় পরীক্ষা কমিটির না থাকতে পারে, কিন্তু মানবিক কারণে হলেও কিছু দায়িত্ব কি পালন করা যায় না? যেমন দু-এক নম্বরের জন্য ছাত্রছাত্রীরা অকৃতকার্য হলে বা ভালো গ্রেড থেকে বঞ্চিত হলে, সে ক্ষেত্রে পরীক্ষা কমিটি বিশেষ বিবেচনা করতে পারে না? যদি নিয়মানুযায়ী না পারে, তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটি পথ বের করা দরকার। 

আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে প্রথম শ্রেণি পাওয়ার জন্য কোনো শিক্ষার্থীকে ৩ নম্বর পর্যন্ত গ্রেস দেওয়া হতো বলে জানি। গ্রেডিং পদ্ধতিতে সে ব্যবস্থা হয়তো নেই। কিন্তু পরীক্ষা কমিটি চাইলে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটা সমাধানে আসতে পারে। বিষয়টি গণিত হলে হয়তো এ কথা বলা যেত না। কিন্তু সাহিত্য বা এ–জাতীয় তত্ত্বীয় বিষয়গুলোতে পরীক্ষকেরা মূলত বিষয়গতভাবে মূল্যায়ন করেন। ফলে এক পরীক্ষকের সঙ্গে অন্যজনের মূল্যায়নে তারতম্য হয়। অর্থাৎ এ বিষয়ের উত্তরে শুধু ভুল বা শুদ্ধ বিচার না করে শিক্ষার্থীর সাহিত্যবোধের মূল্যায়ন করা হয়। 

ভাবতে হবে, যে শিক্ষার্থী ৩৮-৩৯ পেয়ে ফেল করলেন, তাঁর সঙ্গে যে শিক্ষার্থী ৪০ পেয়ে পাস করলেন, তাঁর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য করা যায় কি না। কিংবা যে শিক্ষার্থী ৫৯ নম্বর পেয়ে বি মাইনাস পেলেন, তাঁর সঙ্গে ৬০ নম্বর পেয়ে বি পাওয়া শিক্ষার্থীর পার্থক্য কতটুকু, বিশেষত সাহিত্য ও তত্ত্বীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে? 

এসব বিষয় মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগের মতো গ্রেস নম্বর দেওয়ার অধিকার পরীক্ষা কমিটিকে দিতে পারেন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্ট হলে শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জ বা আপিল করতে পারবেন না কেন? এ ক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে, উত্তরপত্রে দুই পরীক্ষকের নম্বরের তারতম্য হলে তা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ব্যবধান হতে হবে অন্তত ১৫ নম্বর। যেখানে এক-দুই নম্বরের জন্য ভাগ্য নির্ধারিত হয়, সেখানে তৃতীয় পরীক্ষকের ওপর নির্ভর করা কতটা কার্যকর? 

বিশ্বজিৎ চৌধুরীপ্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক